শৈশব স্মৃতি ১ঃ শাস্তির অভিজ্ঞতা

শৈশব স্মৃতি ১ঃ শাস্তির অভিজ্ঞতা

‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।’ আসলে বাস্তব জীবনে কেউ এসে কাউকে মুক্ত করে নিয়ে যায় না, নিজেকেই নিজের মুক্ত করতে হয়। পরাধীনতার শিকল ভাঙতে হয়, ভাঙতে গিয়ে কখনো কখনো নিজেকে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে হয়। প্রতিটি ভাঙ্গা কণা থেকেই আবার নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়। জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে সেটাই শিক্ষা দিয়েছে।

যতদূর মনে পড়ে, বড় মামা আমাকে গ্রাম থেকে ঢাকায় বড় ফুফুর বাসায় নিয়ে আসেন। জীবনের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ১৯৯৬ সালের জানুয়ারীতে, ক্লাস নার্সারি। মামার মতে আমার বয়স তখন চার পেরিয়ে কেবল পাঁচে পড়েছে। গ্রামে মা আদর্শলিপি থেকে বাংলা বর্ণমালা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন বাবা বিদেশ থাকতেন, তার ভাষ্য মতে মা আমাকে বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলে ফেলবেন। তাই ফুফুর কাছে পাঠান আমাকে মানুষ করার জন্য। আমি বড় সন্তান। মা, নানু , ছোট বোনদের, আর খেলার সাথীদের ছেড়ে আসার সময় বুঝতে পারিনি যে ঢাকায় পড়তে যাচ্ছি, ভেবেছিলাম মামার সাথে বেড়াতে যাচ্ছি। মেঘনা নদী পার হবার সময় বাসের জানালা দিয়ে ছোট্ট মুখখানি বের করে আমি বিড়বিড় করে বলছিলাম “মামার বাড়ির পাশে নদী, নদীতে নৌকা চলে” মামা প্রায়ই এই গল্প সবাইকে বলেন। 

ফুফুর হেফাজতে আমাকে রেখে চলে যান মামা। কড়া শাসনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছিল, আর্মি ট্রেনিং বললেও খুব বেশি ভুল হবে না। পরীক্ষায় এক দুই নম্বর কম পেলে পেটের মধ্যে মোচড় মারত। বাসায় এসে উত্তম-মধ্যম খাওয়ার ভয়। ফুফু নিজেই প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘন্টা আরবী পড়াতেন। একদিন পড়া দিতে না পারায় হাত পাখা দিয়ে মারার সময় কীভাবে যেন ডান চোখে গুতা লেগেছিল, চোখ ব্যান্ডেজ করে রাখতে হয়েছিল। কিছুদিন এই উছিলায় স্কুলে যেতে হয়নি। মানা ছিল মা’কে যেন এই ঘটনা না বলি, বলিনি। মনে আছে, অনেক মার খেতাম ছোট বেলায়। ফুফু তো মারতেন পড়ালেখার জন্য, আর বাকীরা পান থেকে চুন খসলেই মারতো। পানি দিতে বলেছে, পানির গ্লাস দুই হাতে ধরলাম না কেন, পড়তে বসে পেন্সিলের রাবার কামড়াচ্ছি কেন, মেহমান এলে কি নাম, কোন ক্লাসে পড়ি, সেটা বলার ভঙ্গিতে ভুল হয়েছে কেন, খেতে বসে হেলান দিচ্ছি কেন, ভাতের লোকমা দিতে আঙ্গুল উঠল কেন, পানি বা দুধ খেলে মুখের চারপাশে লেগে যায় কেন, এমন অসংখ্য কারণে থাপ্পড়, ধমক, কান মলা সহ নানান রকমের শাস্তির আতঙ্কে থাকতাম। বাথরুমে থাকার সময় আর নিজে নিজে যখন গোসল করতাম তখন একটু শান্তিতে থাকতাম। সেখানে নিজের সাথে নিজে কথা বলতাম, সেই থেকে নিজের সাথে নিজে কথা বলার অভ্যাস।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ২ঃ বাল্য বিয়ে ও আমার স্বপ্ন ভাঙার গল্প


একদিন সূর্য মামা যেন অনেক আলো নিয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে। মা এসেছে আমাকে দেখতে, আনন্দ আর ধরছে না। সাথে শক্তি আর সাহস ও। “মা” শব্দটাই যেন স্বস্তি, নির্ভরতা আর শান্তি নামিয়ে নিয়ে আসে ধরণীর বুকে। যে কয়দিন মা ছিলেন মাইর খাওয়া হয়নি, আর খেলেও সেটা বোধ করি গায়ে লাগতো না। তখনো ঘড়ি ধরে ঘুম, খাওয়া, গোসল, পড়া সবই করতে হত কিন্তু কষ্ট হত না। যেটুকু সময় পেতাম মায়ের সাথে থাকতাম। আমার ফুফুকে মা খুব সমীহ আর ভয় করতেন। ফুফু বেশ ভালো মানুষ তবে প্রচন্ড রাগী। কেউ কেউ বলে এটা তিনি জেনেটিক্যালি পেয়েছেন তার বাবার থেকে। দাদার বড় সন্তান হিসেবে সব কিছুতেই বেশ প্রভাব আছে তার। আর আমার মা নানুর একমাত্র আদরের মেয়ে। অনেকগুলো ছেলের পরে সাধনা করে নানু তাকে পেয়েছেন, শান্ত, নিরব আর অসম্ভব সরল। বাবার বা ফুফুর সিদ্ধান্তের কাছে মা বরাবরই অসহায়।

মা যেদিন ঢাকা থেকে চলে যায় তার পড়নে কচি পাতার মত সবুজ রঙের বোরখা ছিল। তার চলে যাওয়ার দিকে পলকহীন তাকিয়েছিলাম, দেখতে দেখতে সবুজ রঙটা বাতাসের সাথে মিলে গেল। এই রঙ যখন যেখানে দেখতাম, চেয়ে থাকতাম এক দৃষ্টিতে। এ তো মায়ের রঙ, চেনা, পরিচিত, আপন রঙ। অনুভবে মা’কে পেতাম সবখানে। সুদূর থেকে বাতাসে করে যেন মা তার গন্ধ পাঠিয়ে দিত আমার কাছে, আমি চোখ বন্ধ করে প্রাণ ভরে গভীর নিঃশ্বাসে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরম যত্নে মেখে নিতাম মায়ের গন্ধ।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ৩ঃ আত্মবিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে


১৯৯৭ সালে নার্সারী থেকে ক্লাস ওয়ানে উত্তীর্ন হই। শাসনের জীবন চলতে লাগল, সাথে চলতে লাগল প্রথম হবার প্রতিযোগিতা যেটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের। ফুফু নিজে আরবীর পাশাপাশি স্কুলের সব পড়া পড়াতেন, ফুফাতো বোনদের মধ্যেও একজন পড়াতেন, আবার একজন শিক্ষকও আসতেন সন্ধ্যায়। আমার বাংলা বইয়ে একটা ছড়া ছিল “কণার হাতে বীনা, সে বীণা বাজায়’, পাশে  বীণা হাতে একটা মেয়ের ছবি। ছবির মেয়েটার বুকে পেন্সিল দিয়ে দুইটা ফোটা এঁকে আমার শিক্ষক বললেন এটা তোমার আপু, তাকে দেখিও। আপুকে দেখাই, রাবার দিয়ে মুছে হেসে দিয়ে বলে, কাউকে বলিস না। এভাবে আবার এঁকে দেন, লিখে দেন কি সব। আপুকে দেখাই হেসে আবার মুছে দেন। কৌতুহল নিয়ে প্রতিদিন প্রশ্নের তারার জাল বুনতে বুনতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতাম। কয়েকদিনের মধ্যে আমার আরেকজন ফুফাতো বোনের বিয়ে হয়। ছেলে সম্পর্কে তাদের আত্মীয় হয়, বয়সে অনেক বড়। বিদেশ থাকে, ছুটিতে এসে বিয়ে করেছে। বিয়ের পরে আপু এখানে আসেন বর নিয়ে। সবাই মিলে গল্প করার সময় তার বর তাকে ডাকে। আপু যেতে চায় না, জোর ধরে বসে থাকে। শেষে ভাইয়া এসে ধস্তাধস্তি করে টেনে হিঁচড়ে কোলে তুলে নিয়ে ধুম করে দরজা দিয়ে দেয়। কেউ বাঁধা দেয় না বরং সবাই হাসে। তাদের রুমে জল, নাস্তা বা কিছু নিয়ে যদি কখনো যেতে হয়েছে, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি, কাউকে কিছু বলতে বা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, জিজ্ঞেস করলে কষিয়ে একটা চড় খাব জানি। আগে পরে খেয়েছি। এমন অস্বাভাবিক অনেক ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি ছোটবেলায়। দেখতে দেখতে আর অস্বাভাবিক লাগে না। সব কৌতুহল দমন করে মন দিয়ে পড়ি। অনিচ্ছায় হলেও নিয়ম, শৃঙ্খলা, শাসন, বারণ মেনে চলি। একসময় আর পারছিলাম না। প্রচন্ড কান্নাকাটি করি, বিদ্রোহী হয়ে উঠি। বিদ্রোহ বলছি এই কারণে আমি হুমকি দিয়েছি যদি আমাকে মায়ের কাছে না নিয়ে যাওয়া হয় আমি মাল্টিপ্লাগের ছিদ্রতে হাত দিয়ে দেব যেন শক খেয়ে মরে যাই। এর পরে এই আপদ তারা আর রাখার সাহস করেনি।

লেখকঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

ছবিঃ Stop All Domestic Violence.com


মঙ্গল, ৯ ফেব ২০২১, সকাল ৫:২৯ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ