স্কুলে বুলিং, তার পরিণাম এবং প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ
ডঃ সানজিদা সুলতানা
কেম্ব্রিজ ডিকশনারীর মতে, যদি কোন ব্যক্তি অন্য কাউকে, জেনে বুঝে কষ্ট দেয় কিংবা ভয় দেখায় বা তাকে দিয়ে এমন কোন কাজ করায় যা তাৱ পছন্দ নয় তাহলে সেই ব্যাক্তিকে bully বা উৎপীড়ক বলে। পশ্চিমা এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলে প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন bullying (বুলিং) এর শিকার হয়। এই সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। বাংলাদেশেও বুলিং একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তেমন এক ঘটনা নিয়েই এই লেখা।
আবীরের (কাল্পনিক নাম) বয়স চার, এই বয়সেই সে বেশ কিছু গান রপ্ত করেছে, ছবিও আঁকে মন দিয়ে। তার মা তার ব্যাপারে একটু বেশীই যত্নশীল, কারণ তার মুখে আছে বেশ বড় লাল রঙের জন্মদাগ - যা তাকে বাকিদের থেকে দেখতে আলাদা করে তোলে। মা মনে করেন তার শিশু প্রতিভাবান এবং তাকে যেন শিশুরা ঐভাবেই মনে করে, তার জন্মগত খূঁতের জন্য নয়। প্রথমদিন আবীর যখন (ইংলিশ মিডি্য়াম) স্কুলে যায় তখন সে বেশ হাসিখুশী ছিল এবং বাকী শিশুদের বোঝাচ্ছিল যে স্কুল ভালো, এখানে বন্ধু হয় এবং বাড়ীর থেকে বেশী খেলনা আছে। কিন্তু এই খুশী বেশীদিন থাকলো না। মাস দুয়েকের মধ্যেই দেখা গেল যে, আবীর আর স্কুল যেতে চায় না, রাত্রে বিছানা নষ্ট করছে এবং হীনমন্যতায় ভুগছে। সে নিজেকে নিয়েও খুশী না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আয়নার সামনে। এই বয়সেই মাকে বলে মূখের দাগ মুছে ফেলতে। অসহায় মা শ্রেণীশিক্ষিকার শরণাপন্ন হলেন। শিক্ষিকা দৃঢ়ভাবে জানালেন যে, তিনি বেশ সতর্ক এ ব্যপারে, এবং শিশুরা সবাই ছোট, তাদের দ্বারা খারাপ ব্যবহার করা সম্ভব না।তিনি এটাও যোগ করলেন যে আবীরের অনেক বন্ধু, তারা তাকে ভালোবাসে, হয়তো নতুন পরিবেশ এবং রুটিন পাল্টানোর জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে, চিন্তার কিছু নাই।
মা নিশ্চিন্তে বাড়ী চলে আসলেন। কিন্তু আবীরের ব্যবহারে কোন পরিবর্তন দেখতে পেলেন না, বরঞ্চ সময়ের সাথে সে আরও পিছিয়ে যেতে থাকলো, নতুন যোগ হল হাল্কা তোতলামী। শুধু তাই নয়, আবীর নিজেকে সবার থেকে আলাদা ভাবা শুরু করল। অন্য আরেকটা উপসর্গ যোগ হল, সে কথা লুকানো শুরু করল। প্রায়ই তার গায়ে নীলচে দাগ পাওয়া গেলেও সে পড়ে গিয়েছিল বলে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করল। স্কুলে কাউন্সেলিং এর সেবা আছে বলা হলেও আদতে তার ব্যবস্থা ছিল না। “পাছে লোকে কিছু বলে” এই ভয়টাই কাজ করছিল, তাই আবীরের মা-বাবা পরিবারের কারো সাথে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করল না। ওরা কোনভাবেই এর সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না।
শিক্ষিকা খুব ভালো করেই জানতেন শ্রেণীকক্ষে কি হচ্ছে। তার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে শিশুরা কম বেশী সবাই ঝগড়া করে এবং মিটিয়েও ফেলে, তারপরেই আবার বন্ধু হয়ে যায়। তাছাড়া আবীরের মা বেশী চাপ দেননি তাই এটাকে এত পাত্তা না দিলেও চলবে। অপরদিকে যে শিশুটা বুলিং করছে (আবীরকে মারছে, ভূত বলছে, বাকী শিশুদের ভূতের মুখের দাগ না যাওয়া পর্যন্ত খেলতে দিচ্ছে না) তার পরিবার প্রভাবশালী। তার উপর শিশুটির মা-বাবা ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবার থেকে চাপ আছে শিশুর উপর বেশী যত্নশীল হতে। বাবা-মা এটাও জানিয়েছেন যে, তাদের শিশু বিষাদগ্রস্ত এবং একারনে আজকাল রূঢ় আচরন করছে। এমতাবস্থায় শিক্ষিকার জন্য মনস্থ করা সোজা হয়ে গেল যে কাকে তিনি বেশী সাহায্য করবেন।
এক কি দুই মাসের মধ্যে শিক্ষিকা আবীরের মাকে ডেকে জানালেন যে, ক্লাসে থাকা পেপার কাটার দিয়ে আবীর ওর নিজ মুখে আঘাত করতে চেয়েছে। উনি সতর্ক ছিলেন বলে আবীরের বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। আট মাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে এক সাধারণ মা শিশুকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। কারন উনি জানতেন যে স্কুল থেকে সাহায্য পাবেন না। প্রভাবশালী পরিবারের সাথে পেরেও উঠবেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিবারের সাথে আর কোনই যোগাযোগ করেননি। আবীর চৌদ্দ বছরের জীবনে তিনটা স্কুল পাল্টে ফেলেছে। স্কুলে ওর বন্ধু হয় না, শিশুরা মজা করে “ভূত”, “এলিয়েন”, “সার্ফ এক্সেল” ডাকে, সাবান দিয়ে দাগ যাওয়ার বুদ্ধি দেয়। হীনমন্যতায় ভোগার কারণে সে নিজেকে সাহায্য করতে পারে না। মাকে সে অবিশ্বাস করে, অপছন্দ করে স্কুলে পাঠানোর জন্য। পড়াশোনা একদম করতে চায় না। মনে করে, না পড়লেই তো স্কুলে যেতে হবে না। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারনে বাড়তি মন খারাপ থাকে। নতুন স্কুলের শিক্ষক ভালো মানুষ, আবীরকে পছন্দও করেন, কিন্তু আবীর জানে ওর মাঝে পছন্দ করার মত কোন গুণ নাই। শিক্ষকরাও অনেক বানিয়ে কথা বলে, এদেরকেও বিশ্বাস বা সম্মান করার কিছু নাই।
শেষ কথাঃ শুধুমাত্র কিছু ভূল সিদ্ধান্তের কারনে আবীর এখনো কষ্ট পাচ্ছে। আবীরের বাবা-মা আরও কঠোরভাবে স্কুলে, শ্রেণীশিক্ষিকা এবং স্কুলের প্রধানের সাথে যোগাযোগ রেখে আবীরকে পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন। এতে করে শ্রেণীশিক্ষিকা নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না, তার কাজের জবাবদিহিতা থাকত এবং তিনি এত জোরালো ভাবে পক্ষপাতীত্ব করতে দ্বিধা বোধ করতেন। এছাড়াও আবীরের অভিবাবক শিশুর মানসিক সমস্যাগুলোকে লুকিয়ে না রেখে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে ভালো সাইকোলজিকাল কাউন্সেলর এর সাহায্য নিতে পারতেন। স্কুলের জন্য সবচেয়ে বড় পরামর্শ হল, সব শিশুই সমান। দায়িত্ব নিলে সবাইকেই সমানভাবে দেখতে হবে। স্কুলে বুলিং মোকাবিলার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি আন্তরিকতা, এবং শিক্ষক, ছাত্র এবং অভিভাবক মিলে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশই পারবে বুলিং কমাতে।
ছবি: Kids vector created by pikisuperstar - www.freepik.com
সোম, ১৪ সেপ্ট ২০২০, সকাল ৪:৩৩ সময়
Login & Write Comments