জেন্ডার সামাজিকীকরণ: পরিবর্তন আনতে হবে আমাদেরই
সোয়ালিহীন ফাতিমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল, ভালো চাকরি করা আদরের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন মা-বাবা কিন্তু সংসারে মেয়েটা ভালো নেইI প্রতিনিয়ত মানসিক, এমনকি শারীরিক নির্যাতনে দিন কাটে। তবু একটা নির্যাতনমূলক তিক্ত সম্পর্কে বাধা থেকে গেলো। কিন্তু কেন?
একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা চৌদ্দ বছর বয়সী দুই কাজিন। ফারাকটা তৈরী হলো গত তিন বছরে। ছেলেটি ইতিমধ্যে গাড়ি, মোটর সাইকেল চালাতে শিখে গেছে, মেয়েটিকেও শেখানো হবে - একটু রয়ে সয়ে। এদিকে বেশ কিছুদিন হলো মেয়েটা ওসিডিতে আক্রান্ত। টালমাটাল তার আত্মবিশ্বাস।
একজন উচ্চ শিক্ষিত পুরুষ - উচ্চমূল্যের চাকরিও করেন। তবু প্রতিনিয়ত চাপ বোধ করেন আমার কিছু হলে আমার স্ত্রী-সন্তানের কি হবে!
ঘটনাগুলো ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের গল্প, কিন্তু এক জায়গায় দারুণ মিল দেখতে পাই। তা হলো - জেন্ডার সামাজিকীকরণ। পুঁজিবাদকে তুষ্ট করা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার নারী ও পুরুষকে কেমন ভূমিকায় দেখতে চায় তারই কিছু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এই গল্পগুলো।
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শিশু ছেলে বা মেয়ে হয়ে উঠতে শেখে তাকে বলা হয় জেন্ডার সামাজিকীকরণ। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় জেন্ডার সামাজিকীকরণ একটি চলমান শিখন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সমাজে নারী পুরুষের ভূমিকা সংশ্লিষ্ট রীতিনীতি, মূল্যবোধ আত্মস্থ করে ও সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ করে। হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি এই পরিচয় নারীর প্রতি অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। এখানে পুরুষের কাজ ক্ষমতা, শক্তি ও সম্মানের সমার্থক আর নারীর কাজ অধস্তন, দুর্বল ও সেবার সমার্থক। আমাদের সমাজে আজও এই বৈষম্য গভীরভাবে উপস্থিত। ফলে এখনো বাল্য বিয়ের উচ্চ হারে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার শুধুমাত্র প্রকাশিত সংখ্যা বছরের প্রথম নয় মাসে ১১৭০, নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২১ শতাংশ আর প্রতিটি পরিবারের না বলা যাতনার গল্প তো রয়েই গেলো যা পরিবার ও গোটা দেশকে পিছে টানছে নিঃশব্দে। তাই রূপকথার সেই প্রাণভোমরার মতন জেন্ডার সামাজিকীকরণে সচেতনতা ছাড়া উন্নয়নের সমীকরণ মেলানো যাবে না।
জন্মের পর থেকেই জেন্ডার সামাজিকীকরণ আরম্ভ হয়। তবে ইউনিসেফ এর ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী জেন্ডার সামাজিকীকরণ চর্চা প্রকট হয় কৈশোরে, যা কৈশোর ও পরবর্তী জীবনে শিক্ষা, পেশা, আয়, ক্ষমতায়ন ও জীবনমানের অন্যান্য সূচকে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরী করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু ছয় মাস বয়সেই নারী ও পুরুষ কণ্ঠকে আলাদা ভাবে চিন্তাতে পারে। তিন বছর বয়সের মধ্যে নিজের জেন্ডার সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায় ও সমগোত্রীয় জেন্ডারকে পর্যবেক্ষণ ও অনুকরণ করতে আরম্ভ করে।
মা-বাবা, শিক্ষক, বন্ধু, ও মিডিয়া হলো সামাজিকীকরণের প্রাথমিক মাধ্যম। জন্মের পর থেকেই ছেলে ও মেয়ে শিশুর ভিন্ন রঙের পোশাক, ভিন্ন রকম খেলনা, স্কুলে ভিন্ন সারিতে বসা, পাঠ্য বই, টিভি বা পরিবারে নারী পুরুষের প্রথাগত চরিত্রায়ন ইত্যাদি নানা মাধ্যমে শিশু ছেলে বা মেয়ে হিসেবে তার পরিচয় তৈরী করে নেয়।
একটি প্রচলিত ধারণা হলো জেন্ডার মানেই পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা। সত্য হলো এই যে, প্রথাগত জেন্ডার পরিচয় নারী পুরুষ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। নারীকে সিদ্ধান্ত, সম্পদ ও ক্ষমতা থেকে দূরে রাখে অথবা ক্ষমতায়নের নামে দ্বিগুণ বোঝা চাপিয়ে দেয়। অন্যদিকে পুরুষকে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। নারী ও সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, গৃহস্থালি কাজের অসম বন্টন আপাতদৃষ্টিতে পুরুষের জন্য সুবিধাজনক হলেও এর প্রভাব পড়ে তার মানসিক স্বাস্থ্যে, দাম্পত্য সম্পর্কে ও সন্তানের জীবনে। এটা তার জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে যার অন্যতম প্রকাশ ঘটে জেন্ডার ভিত্তিক/নারীর প্রতি সহিংসতায়।
নারী পুরুষের ভূমিকার এই ক্ষতিকর আখ্যান পরিবর্তন করতে হলে আমাদের কাজ করতে হবে সম্মিলিত ভাবে, সকল স্তরে। যেহেতু পরিচয় গঠনের প্রথম পাঠ হয় পরিবারে, তাই বাবা মাকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবারে বাবা-মায়ের সমতাভিত্তিক সম্পর্ক এবং ছেলে-মেয়ের সাথে সমতাভিত্তিক আচরণ শিশুকে ক্ষতিকর বৈষম্যমূলক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে নারী ও পুরুষকে দেখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আসুন আমাদের মেয়েশিশুকে গোলাপি রাজকন্যা না সাজাই; ছেলে মেয়ে দুজনকেই বল, পুতুল, হাড়ি ও গাড়ি দিয়ে খেলতে দিই; রান্না ও ঘরের কাজে অভ্যস্ত করে তুলি উভয়কেই। তাদের জন্য সে সব বই বা সিনেমা নির্বাচন করি যেখানে নারীকে সাহসী ও সক্ষম চরিত্রে দেখায়।
জেন্ডার সামাজিকীকরণে কৈশোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন পরিবার ও সমাজ ছেলে মেয়েদের প্রথাগত নিয়মে চলতে চাপ সৃষ্টি করে। তাই এসময় মা বাবাকে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। অতি সুরক্ষার নামে কিশোরীর আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে তাকে যেন আরও অসহায় না করি বরং নিরাপদ থাকার কৌশল শেখাই, কিশোর ছেলেটির কান্না পেলে মেয়েলি বলে লজ্জা না দেই বরং কাঁদতে দেই তাকে। দুজনকেই খেলাধুলা ও শরীর চর্চার সুযোগ দেই, সহনশীলতার দীক্ষা দেই দুজনকেই। সন্তানের কথা শুনি ও আলোচনা করে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই, কিশোরীকে বিয়েকেন্দ্রিক জীবন নয় - জীবনকেন্দ্রিক স্বপ্ন দেখতে শেখাই, বাইরের রূপ যেমনি হোক নিজেকে ভালোবাসতে শেখাই। সর্বোপরি, দাম্পত্য সম্পর্কে সমতা ও সম্মানে সন্তানের রোল মডেল হই।
যেহেতু সামাজিকীকরণের মাধ্যম অনেক ব্যাপক, তাই বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মিডিয়া, প্রতিবেশী, বন্ধুদের চাপ ছেলে মেয়েকে প্রথাগত পুরুষত্ব বা নারীত্বের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তবে পরিবারে একটি সমতাভিত্তিক চর্চা তাকে ক্ষতিকর পরিচয়ের উর্ধে মানবিক, সক্ষম ও দায়িত্বশীল একজন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে যা প্রতিটি মা-বাবা প্রত্যাশা করেন।
ছবিঃ Pinterest
রবি, ১৩ ডিসে ২০২০, রাত ২:১২ সময়
Login & Write Comments