শৈশব স্মৃতি ৩ঃ আত্মবিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

শৈশব স্মৃতি ৩ঃ আত্মবিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

শৈশবে ঢাকায় থাকা, গ্রামে ফিরে আসা, হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়া। জীবনের বাঁকগুলো একটার থেকে একটা এত বৈচিত্র্যময়, এত আলাদা! একেকটা জায়গায় একেকটা নতুন আমিকে আবিষ্কার করছি। এখন আমি গ্রামের গোলা ভরা ধান,পুকুর গোয়াল সমৃদ্ধ কোনো গৃহস্থ ঘরের বউ। যাকে খুব ভোরে উঠতে হয়, ফজরের নামাজ আদায় করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে বাসি থালা-বাসন নিয়ে পুকুরে যেতে হয়, কাকপক্ষী জলে মুখ দেয়ার আগে রান্নার জল তুলতে হয় পুকুর থেকে, রান্নায় কাটাকুটির যোগান দিতে হয়, এভাবেই দিন শেষ হয়ে রাত আসে আবার দীর্ঘরাত শেষে প্রতিদিন সূর্য উঠে। 

বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ভালো হয়েছে। স্কুলের ভর্তির জন্য ছেলের বাবাকে বললে তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। ঘটক ভাইকে বলি, আপনি তো বলেছেন কিছু পরিবর্তন হবে না এখন এমন হচ্ছে কেন? সে জানায় ছেলের বাবা নাকি ভরসা পান না আমাকে স্কুলে দিতে যদি অন্য কারো নজর পড়ে আমার উপর এই ভয়ে। 

সবদিকে চেষ্টা করলাম, সবাই এক নৌকার মাঝি। অনেক আশা নিয়ে শেষ ভরসার জায়গা আব্বাকে জানালাম। সব শুনে তিনি খুবই স্বাভাবিক। কারণ তিনি আমি বলার আগেই সব খবর পেয়েছিলেন। আমার দুঃখ-দুর্দশা তাকে একটুও স্পর্শ করেনি বুঝে গেলাম। তাও অনুরোধ করলাম, আমি স্কুলে যেতে চাই বিনিময়ে আমি তাদের সব কাজ করে দেব, সব কথা মেনে চলব, যা করতে বলবে সব করব তবু আমাকে যেন স্কুলে যেতে দেয়। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে অনুরোধের পর অনুরোধ করে গেলাম। ফোনে তিনি আমার চোখের জল না দেখলেও এতটা নির্বোধ নয় যে আমার আকুতিতে তা বুঝেননি। তিনি সাফ জানালেন, তিনি কিছু করতে পারবেন না এবং এখন আমি তাদের ছেলের বউ, তারা যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে। অনেক কষ্ট নিয়ে তাকে বললাম, এরকম জীবন আমি চাইনা, স্কুলে যেতে না দিলে আমি আত্মহত্যা করব। প্রত্যুত্তরে বললেন, “তোর যা ইচ্ছা কর।” আমার পৃথিবী ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। আর একটি কথাও মুখ দিয়ে বের হলো না, শুধু দু চোখের জলের স্রোতে আমি যেন ভেসে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলাম। সে বছর ভর্তি হতে পারলাম না।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ১ঃ শাস্তির অভিজ্ঞতা


২০০৫ এ আব্বা দেশে এসেছেন ছুটিতে। তার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেদিন একটু খেলতে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যায় ফিরে এসে মায়ের সাথে কোনো একটা বিষয়ে তর্ক করছিলাম। আব্বা এসে কষিয়ে বা গালে এমন থাপ্পড় দিলেন যে নাক কেটে নাকফুল পড়ে গেছে। মাথা ভনভন করছিল। মা ব্যাথিত হয়ে ধরে নিয়ে বসালেন। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠতে দেরি দেখে মা ডাকতে এসে দেখে শরীরে ধান দিলে ফুটে যাবে, গা পুড়ে যাচ্ছে। সারাদিন একটি কথাও বলিনি কারো সাথে মুখেও কিছু তুলিনি। দুই দিন বাদেই ছেলের বাবা এসেছে নিয়ে যেতে। থাকার জন্য এইবার আর বাহানা খুঁজিনি। নিরবে রিক্সায় উঠে চলে গেলাম। পরের দেয়া কষ্ট প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায়, আপনের দেয়া কষ্ট বুকের এপাশ ওপাশ বিদীর্ণ করে দেয় নিরবে। আব্বা দুই মাস থেকে চলে গেলেন। ২০০৫ এও ভর্তি হতে পারিনি অনেক চেষ্টা করে। চেষ্টার উপায়গুলো লিখতে গেলে এটা উপন্যাস হয়ে যাবে। 

যত দিন যাচ্ছে তত একা হয়ে যাচ্ছি। মনে হয় মা ও আমাকে আর আগের মত ভালোবাসে না। নানু আর মামাদের মত ছিলনা এই বিয়েতে তাই তারা রাগ করে বিয়েতে আসেননি। নানুর কাছে গিয়ে থাকার সু্যোগও হয় না।। সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমি একজন মানুষ পাইনি যে আমার আপন। 

সেই ছেলে থাকাকালীন আমার সাথে খাতির পাতানোর জন্য আমাকে বই কিনে দিয়েছিল। বই পেয়ে তাকে একটূ একটু বন্ধু মনে হয়েছিল। সে তার বাবাকেও বলেছে স্কুলে যেতে দেয়ার ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখা যায় কিনা। তার বাবা তাকে ধমক দিয়ে বলেছে, সুন্দরী বউ স্কুলে যেতে দিলে ফিরে এসে আর পাবি না। এই ভয়ে সেও দমে গেল। বাসার কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় যখন একটু সময় পাই হারিকেনের আলোয় বই গুলো নিয়ে বসি। মন ভালো হয়ে যায়। দুইটা বছর গ্যাপ হয়ে গেল পড়ালেখার। তবু প্রতিদিন একটু একটু করে পড়ি। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে বুকে আশা বাঁধি একদিন আবার স্কুলে যাব। 

এমন করে করে দিন কেটে যায়। নিয়মের ছকে থেকে যখন ব্যর্থ হচ্ছি বারবার, তবে নিয়ম ভাঙ্গার পণ করলাম। সব শিকল (সম্পর্ক) ভেঙ্গে, অনেক পথ অতিক্রম করে আমার স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখি। অতিক্রান্ত পথের দীর্ঘ ইতিহাস জীবনের অবসর সময়ে বসে লেখার ইচ্ছে আছে। 

২০০৬ এ নবম শ্রেনীতে ভর্তি হই। ২০০৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ২০১০ এ বোর্ড বৃত্তি নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হই। ব্যাচেলর (দুই বিষয়ে), মাস্টার্স এবং ডিপ্লোমা করি। চাকরি করছি ২০১৭ সাল থেকে। ২০১৮ সালে তরুণদের নিয়ে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কাজের অভিপ্রায়ে ছোট একটা সংগঠন শুরু করি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন যে অপরিহার্য তা নিজের জীবনের অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। অর্জিত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষের জন্য দেশের জন্য অবদান রাখার স্বপ্ন দেখি। জ্ঞান অর্জনে প্রয়োজনে সুদূরে যাব।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ২ঃ বাল্য বিয়ে ও আমার স্বপ্ন ভাঙার গল্প


২০০৪ এর পরে এক যুগেরও বেশী সময় কেটে গেছে। আব্বার সাথে সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। এক যুগ জীবন যুদ্ধের গল্পে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বিচ্ছেদের বিনিময়ে আজকে একটু হলেও স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পেরেছি। এই চেষ্টার অনুপ্রেরণা সাহস, মনোবল যুগিয়েছেন পরম পূজনীয় আমার স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। এছাড়া চলার পথে কয়েকজন পরম বন্ধু আর ভালো মানুষের সান্নিধ্য এই দুর্গম পথের গতি ত্বরান্বিত করেছে। 

মা এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করে। আব্বার চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেন না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। আমি ছোট থাকতে দেখেছি মা অনেক কিছু বলতে বা করতে চেয়েও পারেনি। নিভৃতে নিরবে গভীরভাবে আমি অনুভব করি আমি মায়ের “সাহস,” এমন কিছু মানুষের সাহস যারা পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে নিজের স্বতন্ত্র জীবনের স্বপ্ন দেখে। এখন জীবনকে কিছুটা হলেও অর্থবহ বলতে পারি, কী বলেন?

লেখকঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

ছবিঃ springaccelerator.org


মঙ্গল, ৯ ফেব ২০২১, সকাল ৫:৪৪ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ