বাল্য বিয়ে বন্ধে চাই সামাজিক আন্দোলন

বাল্য বিয়ে বন্ধে চাই সামাজিক আন্দোলন

লাইলী আরজুমান খানম

আমরা জানি যেসকল বিয়েতে কনের বয়স ১৮ বছরের কম বা বরের বয়স ২১ বছরের কম থাকে সেই সকল বিয়েকে বাল্য বিবাহ বা বাল্য বিয়ে বলে। ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুরাই বাল্য বিয়ের শিকার বেশি হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীদের সিদ্ধান্তের তেমন মূল্যায়নই করা হয় না। পড়ালেখা, খাবার, বিনোদন এসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশুদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ধারণা করা হয়, ছেলে শিশু বড় হয়ে বাবা-মাকে দেখবে, তারাই বংশকে যুগের পর যুগ এগিয়ে নিয়ে যাবে; মেয়ে শিশুদেরকে পড়িয়ে তেমন একটা লাভ হবে না। কেননা, বড় হয়ে তারা শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।  সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যে এবং কেউ নীরব থেকে এই এই বাল্য বিয়েকে বৈধতা দেয়। এ কারণে বেশির ভাগ বাবা-মা মেয়ে শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে একজন ভাল পাত্র খুঁজে বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। আর ঐ বিয়েতে মেয়ে শিশুটির মতামত নেয়ার কোন প্রয়োজনই পরে না। সাজিয়ে-গুছিয়ে যখন মেয়ে শিশুটিকে তার স্বামীর ঘরে পাঠানো হয় তখন সে জানেই না যে সংসারটা কত জটিল একটা জায়গা।

বেশির ভাগ মেয়ে শিশুদের শৈশবকাল কাটে কঠিন শাসনের বেড়াজালে আর কৈশোর কাটে শঙ্কায়। নিজের চেনা ভুবন ছেড়ে অচেনা এক বাড়িতে বসবাস করতে তাকে বাধ্য করা হয়। যেখানে থাকে না বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটি, খেলাধুলা আর বই হাতে করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ। চাকরিসূত্রে  সাতক্ষীরা অঞ্চলে বসবাস করায় অনেক নারীর সাথে আলাপ করে দেখেছি  যে, তাদের অধিকাংশেরই ১৫ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। এই সকল বালিকা বধু বলেছে যে শুধুমাত্র বাল্য বয়সে সংসারে প্রবেশ করার কারণে তারা শৈশবের আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি এবং পড়ালেখা করার ইচ্ছে থাকলেও তা পূরণ হয়নি। তারা জানিয়েছে  সংসার যে একটা জটিল বিষয় তা তারা বিয়ের পরে বুঝতে পারেনি, আর সে কারণে তাদের অনেক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি যৌতুকের জন্য শ্বশুর বাড়ি থেকে চাপ দিত এবং অনেক সময় নির্যাতন করতো। তাদের অধিকাংশই অপুষ্টির শিকার। তারা গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তারা যে শিশুর জন্ম দিচ্ছে সেই শিশুও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপুষ্টিতে ভুগছে।

আমাদের দেশে বাল্য বিয়ে রোধ করার জন্য কঠিন আইন আছে। যে আইনের শাস্তি বাবা-মা, অভিভাবক, বিবাহ নিবন্ধক সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য; যেমন অনধিক ২ বছর ও ন্যূনতম ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ মাস কারাদন্ডে দণ্ডিত হবেন। যিনি বাল্য বিয়ে নিবন্ধন করাবেন তার লাইসেন্স বা নিয়োগ বাতিল হয়ে যাবে। অধিকাংশ অভিভাবক এই আইন সম্বন্ধে জানে না। বাল্য বিয়ের শাস্তি সম্বন্ধে অনেক অভিভাবক জানলেও শাস্তি হবে না ভেবে তাদের মেয়ে শিশুদেরকে বাল্য বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় সমাজের প্রভাবশালীদের সহযোগিতা নিয়েও বাবা-মা তাদের মেয়ে শিশুর বিয়ে দিচ্ছেন। এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে বৈধ নয়। অনেক অভিভাবক সচেতনতার অভাবে এফিডেভিটের মাধ্যমে ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে মেয়েদের স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

১৮ বছরের আগে বাল্য বিয়ে একজন মেয়ে শিশুর জন্য অভিশাপ। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত ৩৭ টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়ে শিশুদের সাথে আলাপ করে জেনেছি  যে, তারা পড়ালেখা করতে চায়। এই বয়সে তারা স্বামীর ঘরে যেতে চায় না। ১৮ বছরের আগেই যাতে কোন মেয়ে শিশুকে বিয়ে না দেয়া হয় এজন্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে যখন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তখন কমিউনিটিতে বাল্য বিয়ের প্রবণতা কিছুটা হলেও কমতে দেখেছি। যেমন;

* ইউনিয়ন ও উপজেলাভিত্তিক ইনফ্লুয়েন্সিয়াল দল গঠন এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা

* ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অন্তর্গত বিভিন্ন কমিটিগুলো প্রশিক্ষিত করা এবং কার্যকর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা

* ইউনিয়ন পর্যায়ের যুব ক্লাবগুলোকে সক্রিয় করা, সিনিয়র সাংবাদিক এবং যুব সাংবাদিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা

* ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বাল্য বিবাহ বন্ধে গণ নাটকের আয়োজন করা

* ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতা এবং সাংবাদিকদের নিয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় সভার আয়োজন করা

* বিদ্যালয় ও গ্রাম পর্যায়ে অভিভাবকদের সচেতন করা

* গ্রাম পর্যায়ে পুরুষ সম্পৃক্ততাকরণ দল গঠন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা

* গ্রাম উন্নয়ন কমিটি গঠন ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা

* বিদ্যালয় পর্যায়ে জীবন দক্ষতা সেশন পরিচালনা

* ১০৯ এবং ৯৯৯ নম্বরের ব্যবহার সম্বন্ধে প্রচার করা

* বিদ্যালয় পর্যায়ে সাইকেল র‍্যালী করা ”১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়” 

* বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভা, প্রশিক্ষণে বাল্য বিয়ের উপর একটি অধিবেশন রাখা

* বাল্য বিয়ের শাস্তি সম্পর্কে প্রচার করা

* স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাথে নিয়মিত সভা করা

* ‘১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়’ সম্পর্কিত বিলবোর্ড স্থাপন করা

বাল্য বিয়ে একটি কঠিন সামাজিক ব্যধি। আর তা  রুখতে প্রয়োজন সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ। একদিকে গণ সচতেনতা তৈরি এবং অন্যদিক সমন্বিত মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। তাছাড়াও নারীদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে ক্ষমতায়ন করতে পারলে বাল্য বিয়ে নামক  অভিশাপ থেকে মেয়ে শিশুরা মুক্তি পাবে।

ছবিঃ feminismfirst.org


রবি, ২০ ডিসে ২০২০, রাত ৩:৩০ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ