শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে বাবা-মায়ের কি কি করণীয়?
সাজেদা বেগম
ভ্রূণাবস্থা থেকে শিশুর জন্মের আট বছর বয়স পর্যন্ত সময়টি তার প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই সময়টাতেই শিশুর জীবনব্যাপী শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয়। নিরাপত্তা, খাদ্য, আশ্রয়, এবং স্বাস্থ্যের প্রাথমিক চাহিদা যেমন তাদের শারীরিক বিকাশ নিশ্চিত করে, তেমনি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, ভাষাগত ও আবেগীয় বিকাশের জন্য যোগাযোগ, উদ্দীপনা এবং অন্বেষণের মাধ্যমে শেখার সুযোগগুলো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর বিকাশ (শিশুরা কিভাবে পরিবর্তিত হয়) এবং কি কি কারণে এই পরিবর্তনগুলো ঘটে তা বোঝার জন্য প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ বা ইসিডি সম্পর্কে শেখা বাবা-মা এবং শিশুর যত্নকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে বাবা-মা এবং যত্নকারীরা শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য উদ্দীপনামূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারবে, এবং তাদের বিকাশে বিলম্বগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
গর্ভে আসার তিন সপ্তাহের মধ্যেই একটি শিশুর মস্তিষ্ক পরিপক্ক হতে শুরু করে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার, চিন্তামুক্ত ও মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকা অত্যন্ত জরুরী। তাই পরিবার এবং আশেপাশের সবার দায়িত্ব এই সময়ে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ সম্পর্কে বোঝার জন্য শিশু মনস্তত্ত্ববিদেরা এটিকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। সন্তানের সামগ্রিক বিকাশের জন্য বাবা-মায়েদের এই সবগুলো বিকাশের দিকে একসাথে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এগুলো হলো; শারীরিক বিকাশ (চলাচল ও সমন্বয়ের দক্ষতা), বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ (চিন্তা করা ও শেখার দক্ষতা), সামাজিক বিকাশ (অন্যদের সাথে মেশার ক্ষমতা), আবেগের বিকাশ (নিজের এবং অন্যদের জন্য ইতিবাচক অনুভূতি তৈরির দক্ষতা)।
গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থায় মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয় এবং প্রথম বছরগুলোতে দ্রুত গতিতে তা ঘটে। জন্মের আগে মস্তিষ্ক তার প্রয়োজনের তুলনায় আরও বেশি নিউরন এবং "সাইনাপস" (নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ) উত্পাদন করে। জন্মের সময় শিশুর মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে এবং সেগুলোর মধ্যে ৫০ ট্রিলিয়ন সংযোগ থাকে। ক্রমাগত যোগাযোগ আর উদ্দীপনামূলক পরিবেশ নিউরনগুলোর মধ্যে সংযোগ বাড়িয়ে মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশে সহায়তা করে। যেহেতু তিন বছর বয়সের মধ্যেই একটি মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ ভাগ বিকাশ হয়ে যায় তাই প্রাথমিক এই বছরগুলোতে উদ্দীপনামূলক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। শিশুরা পরবর্তী জীবনে কিভাবে শিখবে এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করবে তার ধাপটি এই প্রাথমিক উদ্দীপনামূলক পরিবেশই ঠিক করে দেয়। ভাল বা খারাপ সমস্ত অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের তারগুলোকে এবং তাদের স্নায়ুতন্ত্রের সংযোগগুলোকে প্রভাবিত করে। প্রাপ্তবয়স্কদের স্নেহমূলক আচরণ ও যোগাযোগ একটি শিশুর মস্তিষ্ককে দৃঢ়ভাবে উদ্দীপ্ত করে, যার ফলে সাইনাপ্সগুলো বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্যমান সংযোগগুলো আরও শক্তিশালী হয়। অন্যদিকে প্রথম বছরগুলিতে কম উদ্দীপনামূলক পরিবেশ শিশুর মস্তিষ্কের সাইন্যাপ্স তৈরি হতে দেয়না, যা মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ বিকাশে বাধা দেয়।
শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করতে শিশুর যত্ন ও প্রতিপালনে অভিভাবকদের যেসব বিষয়গুলোর দিকে নিয়মিত খেয়াল রাখা জরুরী তা হলোঃ
স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করুনঃ প্রসবের পূর্বে নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। জন্মের পর শালদুধ দেয়া, নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা (চেকআপ) এবং সময়মত টিকাদান নিশ্চিত করুন। শিশুদের জন্য নিরাপদ খেলনা এবং খেলার জায়গার ব্যবস্থা করুন।
শিশুদের সাথে ভালোবাসা ও যত্নশীল সম্পর্ক গড়ে তুলুনঃ তাকে বোঝান যে আপনি তাকে অনেক ভালোবাসেন এবং তার ব্যপারে গভীরভাবে যত্নশীল। তাকে দেখে আনন্দ প্রকাশ করুন। তাকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত বোধ করতে সহযোগিতা করুন।
শিশুদের প্রয়োজনে সাড়া দিনঃ শিশুর কোন আচরণ বা প্রয়োজনে অভিভাবক কিভাবে সাড়া দেন তার উপর নির্ভর করে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ। জীবনের প্রথম দিন থেকেই তার মেজাজ লক্ষ্য করুন এবং সে যখন বিরক্ত বা খুশি হয় তখন সেভাবেই সাড়া দিন। শিশুর অনুভূতিগুলো বুঝতে হবে। সে তার ভাষা অথবা অঙ্গভঙ্গি দিয়ে কী বুঝাতে চাইছে তা বুঝার চেষ্টা করতে হবে। শিশুকে আদর করে ভালোবেসে স্পর্শ করুন; তাদের সাথে এমনভাবে খেলুন যেন আপনি তার নেতৃত্ব অনুসরণ করছেন; শিশু যতক্ষণ খেলতে চায় খেলুন, যখন বুঝবেন সে যথেষ্ট উদ্দীপনা পেয়েছে আর মন দিয়ে খেলছেনা তখন খেলা বন্ধ করে দিন।
মনে রাখতে হবে যে প্রতিটা শিশুই আলাদাঃ জন্ম থেকেই প্রতিটি শিশু তার আচরণ ও বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন। তেমনিভাবে তারা তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও আলাদা; কেউ হয়ত একটু আগে বেড়ে ওঠে; আবার কারো হয়ত একটু সময় লাগে।
শিশুদের সাথে কথা বলুন, বই পড়ে শোনান এবং গান করুনঃ জন্ম থেকে শিশুর চারপাশে বই দিয়ে ভরিয়ে রাখুন, শিশুর সাথে কথা বলুন, আপনার প্রতিদিনের কথাগুলি শিশুর সাথে বলুন, শিশুকে গান শুনান, শিশুকে গল্প বলুন, গল্পের বই পড়ে শোনান, শিশুকে বিভিন্ন জিনিসের নাম বলুন। যখন ছোট শিশুদেরকে গল্প বলে শোনাবেন তখন তাদেরকে গল্পের পরের অংশে কি হতে পারে তা অনুমান করতে বলুন। শিশুদেরকে তাদের আশপাশের প্রিয় জিনিসগুলো আঁকতে বলুন। তাদেরকে আঁকাআঁকি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাগজ, রংপেন্সিল, ম্যাগাজিন এবং খেলনা দিন, এই সবকিছুই শিশুর ভাষা, আবেগীয় এবং সৃজনশীল বিকাশের পূর্বশর্ত।
শিশুকে নিরাপদ পরিবেশে খেলতে এবং অন্বেষণে উৎসাহিত করুনঃ প্রাপ্তবয়স্ক কারো তত্ত্বাবধানে শিশু যেন নিজ বয়সি বা অন্য বয়সি শিশুদের সাথে খেলতে, ঘুরে বেড়াতে, একসাথে সময় কাটাতে এবং অন্বেষণের সুযোগ পায় সেই পরিবেশ তৈরি করুন। এই সময়ে তাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হলে সেগুলো যেন নিজেরাই মেটাতে পারে সেই সুযোগ দিন।
শিশুদের শৃঙ্খলা শেখানঃ শিশুদের অনুভূতিগুলো জানতে তাদের সাথে কথা বলুন এবং তাদের সেই অনুভূতিগুলো কিভাবে প্রকাশ করবে তা শিখিয়ে দিন। কেন তাদের কিছু করতে বলা হচ্ছে বা নিষেধ করা হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে বলুন। তাদের কাছ থেকে আপনি কি আশা করেন না সেটা সারাক্ষণ না বলে কি আশা করেন সেগুলো বলুন।
শিশুকে একটি রুটিনে অভ্যস্ত করুনঃ শিশুর খাওয়া, ঘুম, খেলা সবকিছু নির্দিষ্ট সময়ে করুন যাতে সে অভ্যস্ত হয় এবং বুঝতে পারে কখন কোন কাজটি করার সময়।
নিজের যত্ন নিনঃ আপনি নিজের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারলেই আপনার শিশুর সর্বোত্তম খেয়াল রাখতে পারবেন। সন্তানের সুস্থতা আপনার নিজের সুস্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে।
ছবিঃ Pixabay
বুধ, ২৮ অক্টো ২০২০, রাত ২:৫৬ সময়
Login & Write Comments