শৈশব স্মৃতি ২ঃ বাল্য বিয়ে ও আমার স্বপ্ন ভাঙার গল্প

শৈশব স্মৃতি ২ঃ বাল্য বিয়ে ও আমার স্বপ্ন ভাঙার গল্প

ঢাকায় নার্সারি আর ক্লাস ওয়ান শেষ করে গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে আসি ১৯৯৮ সা্লে। মায়ের পরম ভালোবাসার আঁচলে পৃথিবী এখানে স্বর্গকে তুচ্ছজ্ঞান করতেও দ্বিধা করেনা। স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টি যেখানে, জীবন তো সেখানেই! হৃদয়ের স্পন্দনের সাথে শরীরের সংযোগেই তো প্রাণ। আমার জীবনের ছোট্ট প্রাণটাকে ফিরে পেলাম। ফিরে পেলাম আমার সবুজকে। ভর্তি হবার কথা দ্বিতীয় শ্রেণীতে। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরামর্শ দেন তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করার। তার ভাষ্যমতে বাচ্চা এডভান্সড। এই এক বছর এগিয়ে ভর্তি হওয়া পরে পিছিয়ে পড়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। 

মিশে গেলাম সবুজের সাথে। স্কুলের সাথে সাথে শিখে গেলাম সাঁতার কাটা, গাছে উঠা, জাল ফেলা, বঁড়শি বাওয়া, ফুটবল, ক্রিকেট, মারবেল, কাবাডি, সাইকেল চালানো, নারিকেল সুপারি পাড়া, ধান কাটা, সালুক তোলা, শাপলা তোলা, নৌকা বাওয়া। ঘরের কাজের কথা যদি বলি, সবজি কাটা, মাছ কাটা, ভাত-তরকারি রান্না, পাতিল ধোয়া, মাটি দিয়ে ঘর লেপা, নকশী কাঁথা সেলাই, শীতল পাটি, পাখা বুনন, সহ ঘরকন্নার কাজও টুকটাক শিখেছি নিতান্তই মা’কে খুশি করতে। যদিও খুব বেশি দিন খুশি করতে পারিনি। আমার মন ঘরে থাকে না, ছুটে যায় মাঠে ঘাটে। কোথায় কোন গাছে আম পেকেছে, কোন পাখির বাসা ভেঙে গেছে, কোন পুকুরে মাছ ভাসা দিয়েছে, কতগুলো শাপলা ফুল ফুটেছে, শালুক কত বড় হয়েছে, বাগানের গাছের সংখ্যা কত আছে, কোন বীজ থেকে চারা সংগ্রহ করা যায়, ছোট বোনকে কে কবে ধাক্কা দিয়েছে তার শোধ কিভাবে নেয়া যায়, বৃষ্টিতে মজা করে কিভাবে পিছলা খাওয়া যায়, এগুলো নিয়েই আমার জীবন। এগুলো মেয়েদের কাজ নয় বলে মা বিশেষ পছন্দ করতেন না। প্রথমদিকে মৌখিকভাবে নিষেধ করলেও পরে থামাতে না পেরে লাঠির আশ্রয় নেন। ধীরে ধীরে মায়ের উত্তম মধ্যমের মাত্রা বাড়ে সাথে আমার অবাধ্যতাও। মায়ের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা আমি জানি, তাই মারলে খাওয়া বন্ধ করে দেই। ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিতে দিতেও বুঝাতে থাকেন, মেয়েদের এগুলো করতে হয় না, মানুষ খারাপ বলে, সব মেয়েরা কি সুন্দর ঘরে থাকে, আমি কেন তাদের মত না ইত্যাদি। খেয়ে নিয়ে আমি দৌড় দেই। উত্তম মধ্যমের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। মার খেতে খেতে এখন আর গায়েই লাগে না। ধরেই নিয়েছি মার তো খাবই এ আর এমন কি! এর পরে ঘরে বন্দী করে রাখার দিনও আসে। তাতেও আমাকে ঘরে রাখা যায়নি। কেন যে তখন এত অবাধ্য ছিলাম জানি না।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ১ঃ শাস্তির অভিজ্ঞতা


২০০৩ সালে অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। পড়ালেখা নিয়ে মায়ের অভিযোগ নেই। পড়ার জন্য কখনো উত্তম মধ্যম খাইনি। পরীক্ষার ফলাফল সব বিষয়ে ভালো, শুধু গণিত ছাড়া। গণিত শিক্ষক মারতেন, ভয়ে স্কুলে যেতে ইচ্ছা করত না। মা’কে মাঝে মাঝে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে স্কুলে পাঠানোর জন্য। মায়ের উত্তম মধ্যম আর আমার দস্যিপনার প্রতিযোগিতায় এতটাও খারাপ ছিলাম না। যতটা খারাপ থাকা শুরু হয় পরের বছর থেকে।

২০০৪ সালে অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে ছুটি উপভোগ করছি। একদিন আমার এক আত্মীয় ভাই আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মায়ের কাছে আসেন। মা বলে দেন, “আমরা বিয়ের চিন্তা করছি না এখন, ও পড়ছে।” ভাই বিদেশে আব্বাকে ফোনে জানায় এবং কী বুঝিয়ে আব্বাকে রাজী করায় কে জানে! আব্বার কথার উপর মা কথা বলতে পারেন না। ভাই আমাকেও জানালেন আব্বা, মা রাজী এবং ছেলে বিয়ে করে চলে যাবে, আমি মায়ের কাছেই থাকব, পড়ব যেভাবে পড়ছি, কোনো কিছুর ব্যাঘাত হবে না। এখন শুধু বিয়েটা হয়ে থাকবে, কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিকতার জন্য তাদের বাড়ি থাকা হবে। এমন শর্তেই নাকি বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কবুল বলেছি কি বলিনি মনে পড়ে না। বলে থাকলেও সেই কবুলের অর্থ আমি জানি না। বিয়ের মানে আমার কাছে তখন একটা উৎসব। রঙ বেরঙের বাতি, আনন্দ, খাওয়া দাওয়া, অনেক মানুষ, গান, নাচ এগুলোই। তো হয়ে গেল বিয়ে রঙ বেরঙের বাতি জ্বালিয়ে।


আরও পড়ুনঃ শৈশব স্মৃতি ৩ঃ আত্মবিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে


বিয়ের রাতে আমাকে সেই ছেলের মায়ের সাথে ঘুমাতে দেয়া হয়। শেষ রাতে দেখি আমার পাশে সেই ছেলের মা নয় বরং সেই ছেলে। সে আমাকে জানালো সারাদিনে আমার সাথে সে একটি কথাও বলার সুযোগ পায়নি তাই তার মা তাকে শেষ রাতে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। সে গল্প করল আর জানালো সে আমাকে কোথায় কখন দেখেছে এবং কি কৌশলে আমার ভাইকে সে রাজী করিয়েছে আমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যেতে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরের দিন আয়োজন করে একসাথে ঘুমাতে দেয়া হল। অবাক হইনি, কারণ টিভিতে বা বাস্তবে দেখতাম বিয়ে করলে এক কক্ষে ঘুমাতে হয়। স্পর্শ বলতে যা বুঝতাম, বন্ধুদের, খেলার সাথীদের, ছোট বোনদের, মা, নানু, মামাদের জড়িয়ে ধরা, খেলায় জিতলে আনন্দে, আহ্লাদে সাথীদের জড়িয়ে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া। নানু, কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘষে দেয়া মামা্দের পিঠে চড়ে গ্রাম ঘুরে বেড়্নো, মাথায় হাত বুলানোর স্নেহের পরশ। খেলতে গিয়ে কেটে ছিড়ে গেলে কাটা জায়গায় চুমু দিয়ে নানু বলতেন ব্যাথা শেষ। রাতে ঘুমানোর সময় নানুর হাত, মুখ, চোখ, শরীরের যে কোনো অংশ স্পর্শে রেখে ঘুমাতাম। সেই স্পর্শ গুলোতে আদর অনুভব করতাম।

এই স্পর্শ আমার অস্বস্তির, ভয়ের উদ্রেক তৈরি করে। এমন স্পর্শের তীব্র প্রতিবাদ করি, মারমুখী আচরণ, ভাঙচুর করে। ছেলেটা শিক্ষিত এবং আমার চেয়ে বয়সে ১৬/১৭ বছরের বড়। প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা দেখে এ নিয়ে সে আর বাড়ায়নি বরং, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে্, তার পরিবারকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে এখনো সংসার জ্ঞান হয়নি আমার। কিন্তু তা্র পরিবার ঠিকই ঘরোয়া বিচার সালিশ বসায়। আমার মা’কে ডেকে আনে, অপমান করে। তাদের ভাষ্যমতে এমন বয়সে অন্য মেয়েদের ও বিয়ে হয় তারা তো এমন আচরণ করেনা! এভাবে দু মাস কেটে যাওয়ার পর তার মা-বাবার কাছে আমাকে রেখে সে বিদেশ চলে যায়।

লেখকঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

ছবিঃ feminismfirst.org


মঙ্গল, ৯ ফেব ২০২১, সকাল ৫:৩৫ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ