বাংলাদেশে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের অধিকার: ভাষার দেয়াল ভাঙতে হবে
আফরা নাওমী
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছে। তারা দেখতে শুনতে অবিকল আমার আপনার, আর আট-দশটি মানুষের মতই। কিন্তু তারপরও তাদের জীবন আর সেই আট-দশটি মানুষের মতো নয়। কারণ, তারা যেকোন সাধারণ নাগরিকের অধিকার থেকে বঞ্চিত, তাদের প্রতি মানুষের রয়েছে শুধুই আহা-উঁহুঁ, কেবল শুভকামনা। কিন্তু কেন? কারণ তারা কানে শুনতে পান না, মুখে উচ্চারণ করতে পারেন না-তারা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
তাদের আমরা অনেক সময় ‘পিছিয়ে পড়া’ জনগোষ্ঠীও বলে থাকি। কিন্তু তারা পিছিয়ে আছে না তাদের এগিয়ে নিতে পর্যাপ্ত সহায়তা করা হচ্ছে না? কেননা আজকের বিশ্বও একদিন এমন ছিলো না। মানুষের প্রয়োজনেই আজ মানুষ জীবন সহজ করে নিয়েছে। তাহলে কেন তাদের চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য এই বিশ্ব সহজ হচ্ছেনা?
বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দেশের অধিকাংশ জনগণের মতো সব মৌলিক চাহিদা ভোগ করার সুযোগ পায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রতিটি বিষয়ে তারা পিছিয়ে। সমাজ এবং পরিবারও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায় না। যেমন তাদের জন্য সরকারের বিশেষায়িত স্কুল বা প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। সীমিত পরিষেবার কারণে ছোটোবেলা থেকেই তারা পড়াশোনা আর সমাজের মূলধারা শিখন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অথচ এই বিচ্ছিন্নতার একমাত্র কারণ ভাষা। পরিবারও মনে করে কী আর হবে লেখাপড়া করে, কারণ ভবিষ্যতে তার উপযোগী কোন চাকরি নেই।
কিন্তু মনে রাখা জরুরি শ্রবণ বা বাক প্রতিবন্ধী হওয়া মানেই যোগাযোগহীনতা নয়, “এটা কেবল এক ভিন্ন ভাষা” এই উপলব্ধিই হতে পারে অন্তর্ভুক্তির শুরু। এজন্য প্রথমে প্রয়োজন নিজেদের ইশারা ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠা। তাহলে একটি কমন যোগাযোগের ভাষা তৈরি হয়।
ভাষাগত দেয়াল, সচেতনতার অভাব
এই খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা সচেতনতার ঘাটতি। প্রায় সব জেলাতেই বিশেষ স্কুল ও হোস্টেলের ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু পারিবারিক সচেতনতার অভাবে অনেক শিশুই সেখানে যাচ্ছে না, অনেকেই তাদের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
শিক্ষা সহজলভ্য হলে এই জনগোষ্ঠী নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। চাকরির সুযোগও তৈরি হবে। ইন্টারভিউ বোর্ডে তার ভাষা বুঝতে না পারা কিন্তু সেই বোর্ডের সদস্যদের ব্যর্থতা। তাদের নয়। কারণ তারা একটি ভাষা রপ্ত করেছে যে ভাষায় অন্যান্যরাও অভিজ্ঞ নয়। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যদি একজন ইশারা ভাষা জানা ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়া হয়, সে আরও ৫–১০ জনকে সহায়তা করতে পারে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও একই সংকট। হাসপাতালগুলোতে দোভাষী না থাকায় সেবা নিতে গেলে তারা সমস্যায় পড়েন। সেখানেও যদি দোভাষী থাকে তাহলে তাদের চিকিৎসা নিতে সহজ হবে।
মিডিয়া ও সমাজের দায়িত্ব
টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী প্রোগ্রাম তৈরি করতে হবে। ‘বোবা’, ‘কালা’-র মতো ব্যঙ্গাত্মক শব্দ পরিহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সচেতনতা তৈরি করতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরে।
আমাদের দেশের প্রায় সবাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত শুনেছে, কিন্তু “সেই ২০–৩০ লাখ মানুষ শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হয়ত সেই গান না শুনেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে।” এই তীব্র প্রশ্নটি কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়?”
ইশারা ভাষা শেখা এখন হাতের মুঠোয়
ইশারা ভাষা আদিম ভাষা। আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগেও ইশারা ভাষাতেই চলতো যোগাযোগ। তাই একে আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। এটি যোগাযোগের আদিম এবং স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।
বর্তমান সময়ে এসে, ইশারা ভাষাকে সহজভাবে বোধগম্য করতে বেশ কিছু সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ রয়েছে। যেমন বেশ কিছুদিন আগে ইউএনডিপির সাথে একটি অ্যাপ তৈরিতে কাজ করেছি আমি। প্রযুক্তি এখন পরিবর্তনের অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা আমাদের ভাষায় এবং আমরাও তাদের ভাষায় যোগাযোগ করতে পারবো এই অ্যাপে ভাষা রপ্ত করে।
গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে ‘এসো ইশারা ভাষা শিখি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করে এখানে যে কেউ শব্দ টাইপ করলেই সেই শব্দের ইশারা ভাষার প্রদর্শন দেখা যায়। এখন হাতের মুঠোয় ইশারা ভাষা শেখার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়াও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে, এমনকি ১৯৯৬ সালেই তারা প্রায় ৮০০ শব্দের ইশারা ভাষার একটি বই প্রকাশ করেছিল।
সুপারিশ ও পথচলা
৩০ লাখ মানুষকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্র সবখানেই যোগাযোগের দেয়াল ভাঙতে হবে। আমাদের দায়িত্ব এই জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। তার মানে-
- সাধারণ মানুষকে ইশারা ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া
- আরও বেশি দোভাষী তৈরি করা
- শিক্ষাকে সহজলভ্য করা
- স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দোভাষী রাখা
- টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে উপযোগী অনুষ্ঠান তৈরি করা
- পারিবারিক সচেতনতা বাড়ানো
বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হয়, কিন্তু এই লাখ লাখ মানুষকে বাদ দিয়ে সে উন্নয়ন সম্ভব নয়। “আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য একটাই, ভাষা। সেটাই দূর করতে হবে। ইশারা ভাষাও এক ধরনের ভাষা। জন্ম হওয়ার পর আমরা শিশুদের সাথে কিন্তু ইশারা ভাষা দিয়েই যোগাযোগ স্থাপন করি। ইশারা ভাষাও তেমন। এটিকে শেখা যায় আনন্দের মাধ্যমেই”।
২৩শে সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক ইশারা ভাষা দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে শিশুরাই সব কথা বলেছে মো আহসান হাবীব এর সাথে যিনি একজন অভিজ্ঞ সাংকেতিক ভাষা প্রশিক্ষক এবং সাংকেতিক ভাষায় সংবাদ পাঠক, বিটিভি চ্যানেলে। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে যাচ্ছেন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহারকারীদের সাথে এবং তাদের জন্যে। সেই কথোপকথন অনুলিখন করেছে আফরা নাওমী, কমিউনিকেশন অফিসার, শিশুরাই সব।
রবি, ৯ নভে ২০২৫, রাত ১১:৩২ সময়
Login & Write Comments