সন্তান চাইলেই কি সবকিছু দিতে হবে?
ফারাহ্ মেহ্রীন
জন্মের পর মেয়েটিকে দেখে রেজা সাহেবের মনে হয়েছিল যেন কোন এক রাজকন্যা পথ ভুল করে তাদের বাড়ীতে এসে পৌঁছেছে। তাই মেয়ের নাম উনি শুধু শাহজাদীই রাখেননি নিজেদের জীবনের সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছেন উনাদের আদরের প্রিন্সেসকে। যে কোন শিশুর স্বপ্নের মত কেটেছিলো শাহজাদীর ছোটবেলা। ওর বাবা মা তাকে কখনো কোন কাজে বাধাতো দেনই নি, উল্টো তারাই ওর পছন্দমাফিক চলেছেন। সে পোলাও খেতে পছন্দ করত বলে ওর জন্য প্রতিদিন পোলাও হত, ছোট মাছ খায় না বলে শুধু তার জন্য বড় মাছ ভাজি, ঈদের সময় সবার আগে নিজের পছন্দ মত শপিং করত তারপর বাকীদের কেনাকাটা শুরু।
নিজের সপ্তম জন্মদিনে শাহজাদীর ইচ্ছে হলো যে সে ডিজনি প্রিন্সেস সিন্ডারেলা সেজে জন্মদিন পালন করবে। সবকিছু ওর পছন্দমাফিক হলেও দুর্ভাগ্যবসত ওরকম জুতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। সে খুব বিমর্ষ হয়ে ছলছল চোখে তার মা শায়লা বেগমকে বলল, ঠিক ওরকম জুতো যদি পাওয়া না যায় তাহলে কি হবে সে ভাবতেই পারছে না। আসলেই কিছু না পাওয়ার দুঃখ যে কেমন সেটা বাবা মা তখনো পর্যন্ত ওকে বুঝতে দেননি। মেয়ে একটা জিনিস শখ করেছে সেটা না পেলে কষ্ট পাবে এই দুশ্চিন্তায় শায়লা বেগম নেয়ামূল কোরাআন থেকে মনের বাসনা পূরণের জন্য স্পেশাল দোয়া বের করে খতম দিয়ে আল্লাহ্র কাছে খাস দিলে দোয়া চাইলেন। ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময়ে রেজা সাহেবের পরিচিত একজন ব্যাংকক যাচ্ছিলেন। রেজা সাহেব তাকে রিকোয়েস্ট করে ওখান থেকে একই রকম দেখতে ট্রান্সপারেন্ট একজোড়া জুতো আনালেন যেটা দেখে শাহজাদী আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। রেজা সাহেব তখন ওকে আদর করে বললেন, "দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র মেয়ে আমার। সে একটা জিনিস শখ করেছে আমি কি তা না দিয়ে পারি?"
মেয়ের পনের বছর বয়সে পরিবারের সুখের জীবনে প্রথম বাস্তবতা এসে দাঁড়ালো যখন রেজা সাহেব যেই প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেটা উঠে যাওয়ায় উনি হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েন। এই আকস্মিক ঘটনায় উনি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। কারণ একমাত্র মেয়ের সাধ-আহ্লাদ পূরন করতে গিয়ে নিজের কোন সঞ্চয় ছিল না। বহু কষ্টে বিভিন্ন তদবির করে কয়েক মাসের মধ্যে উনি একটা মাঝারি মানের চাকরি পেলেন যার আয় দিয়ে অনেক হিসেব করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আর সেটাই জন্ম দিলো এক নতুন সমস্যার। শাহজাদী সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিতে না পেরে অসম্ভব রকমের রাগী ও জেদি হয়ে গেল। বাবা-মা খুব চেষ্টা করলেন মেয়েকে খুশি রাখার এমনকি নিজেদের বহু জরুরি খরচও কমিয়ে দিলেন ওর শখ পূরণের জন্য। কিন্তু, একসময় ভালবেসে শাহজাদীকে তার বাবা মা যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন এখন সেগুলো ওর কাছে দাবী হয়ে গেছে। আর সাথে যোগ হয়েছে ওর নিত্য নতুন বিভিন্ন শখ, যা না মিটলে সীমাহীন অশান্তির সাথে ডায়ালগ, "তোমরা আমাকে আর আগের মত ভালবাসো না।"
শায়লা বেগম এবার নেয়ামুল কোরআন থেকে বাসায় শান্তি ফিরে আসার জন্য দোয়া পড়া শুরু করলেন। সমাধান একটা বেরিয়ে আসলো। রেজা সাহেব উত্তরাধিকার সুত্রে ঢাকায় এক খণ্ড জমি পেয়েছিলেন যেখানে ভবিষ্যতে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা ছিল। সেই জমি বেঁচে টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট করলেন এবং ওই টাকার ইন্টারেস্ট তুলে মেয়ের বাড়তি খরচগুলো চালাচ্ছিলেন। যদিও খুব বেশিদিন সেই টাকায় চলাও উনাদের পক্ষে সম্ভব হল না। কেননা, শাহজাদী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জানিয়ে দিল বিবিএ ছাড়া সে অন্য কিছুই পড়বে না। আর সেজন্য যদি সে আইবিএতে চান্স না পায় তবে যেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবে সেখানেই পড়বে। অবশেষে তাই হলো। ব্যাংকের টাকা তুলে তাকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো শুরু করতে হল।
২০১৮ সাল শাহজাদীর জন্য তার ভাষায় খুব স্মরণীয় একটা বছর, "দ্যা ইয়ার আই ফাইনালি মেট মাই প্রিন্স চার্মিং।" কিভাবে কি হল তার একটু বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়া যাক। ও তখন একুশ বছরের অত্যন্ত ইমেজ সচেতন একজন মেয়ে। কোন ব্রান্ডের কত নম্বর শেডের লিপস্টিক তাকে সামনা সামনি ভাল লাগলেও ক্যামেরায় ভাল আসে না সেই সব বিষয়ে নিখুঁত দৃষ্টি তার। ওর বন্ধুরাও এসব বিষয়ে ওকে গুরু মানে। এমন সময় শাহজাদীর মনে হল তার ইমেজ আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সাথে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াতটা ঠিক ম্যাচ করছে না। বিষয়টা তার জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছে। তাই সে তার বাবা মাকে বলল যত শীঘ্র সম্ভব ব্যাংকের টাকা তুলে তার জন্য একটা প্রাইভেট কার কিনে দিতে। রেজা সাহেব মেয়ের কথা শুনে রীতিমত ভয় পেলেন। কারন, ব্যাঙ্কে যেই টাকা আছে তা দিয়ে সাধারণ একটা রিকন্ডিশন গাড়ী কিনতে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া সাথে আরও খরচ তো আছেই। ড্রাইভারের বেতন, গাড়ীর মেইনটেনেন্স সেসবই বা উনি কোথা থেকে চালাবেন? অন্যদিকে মেয়ের ইচ্ছে পূরণ না করলে সে আবার কোন অশান্তি শুরু করে তা ভেবে হাইপার টেনশন শুরু হয়ে গেল। এইতো মাত্র কিছুদিন আগে সে আইফোন কেনার জন্য জোর করছিল। রেজা সাহেব তা কিনে দিতে একটু সময় নিচ্ছিলেন বলে একদিন রাগারাগি করে সে পেপার ওয়েট ছুঁড়ে মেরে টিভি ভেঙ্গে ফেলেছে।
শায়লা বেগমও সবকিছু দেখে খুব চিন্তিত হয়ে নেয়ামুল কোরআন থেকে বিপদ মুক্তির দোয়া পড়া শুরু করলেন। ঠিক সেই সময়ে শাহজাদীর জন্য উচ্চবিত্ত পরিবারের এক হ্যান্ডসাম ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব আসলো। উনাদের তখন মনে হল গাড়ী কেনা নিয়ে ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য বিয়েই সব থেকে ভাল সমাধান। আর শাহজাদীও হাই লাইফ লিড করার আশায় বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু গাড়ী কেনার চাপ থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে মেয়েটির বাবা-মা আরও বড় বিপদে পড়লেন। শাহজাদীর রুচিমাফিক বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে গিয়ে উনাদের ব্যাংকে যা টাকা ছিল তা দিয়ে সব হল না। এদিকে মেয়ে হুমকি দিল ওর ইমেজের সাথে মানানসই আয়োজন করা না হলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। বিয়ের দিন সকালে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাবে। মেয়ের কথা শুনে উনারা আরও কিছু টাকা ধার করতে বাধ্য হলেন কিন্তু তাতেও শেষ পর্যন্ত শাহজাদীর ফটোগ্রাফার, মেকআপ আর্টিস্ট ইত্যাদি কিছু খরচ না কুলানোয় আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হল। আর তাদের কেউ যাকাতের টাকাও অফার করল, কেননা, কন্যা দায়গ্রস্থ পিতাকে যাকাত দেওয়া যায় (কন্যাকে নিয়ে দায়টা আসলে যে কোথায় তারা তো সেই ডিটেইল জানে না)। কি আর করা! মেয়ের অশান্তির ভয়ে সেই টাকাও উনারা অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে গ্রহণ করলেন... বিয়ের দিন যখন মোগল থিমে ওয়েডিং- এর পিকচার পারফেক্ট সেট, লাইটিং, মিউজিকের মধ্যে শাহজাদীর সাজ আর ফটোগ্রাফির পোজ দেখে সবাই শায়লা বেগমকে বলছিল যে উনার মেয়েকে সত্যিই মোগল সম্রাজ্ঞীর মত লাগছে উনি তখন চেহারায় শুকনো হাসি নিয়ে মনে মনে ভাবছিলেন, "সেই ছোট্ট রাজকন্যাকে আজকের এই রাজরাণী বানানোর চক্রে পড়ে উনারা প্রায় ফকির হয়ে গেলেন।"
(গল্পটা আমাদের আশেপাশের একাধিক কাহিনীর সমন্বয়ে লেখা হয়েছে যাতে কেউ নিজে রাজ্যের মালিক না হলে মেয়েকে রাজকন্যা বানানোর আগে ভেবে দেখেন। এখানে প্যারেন্টিং এর যেসব ভুল রয়েছে সেগুলো অনেকই করেন। তাই ভুলগুলো কি এবং কিভাবে ঠিক করা যায় সে বিষয়টি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের আলোচনা ও মতামতের জন্য উন্মুক্ত থাকলো।)
বুধ, ৪ নভে ২০২০, রাত ১১:১৯ সময়
Login & Write Comments