অন্যের সঙ্গে তুলনা নয়, শিশুদের উৎসাহ দিন

অন্যের সঙ্গে তুলনা নয়, শিশুদের উৎসাহ দিন

আহনাফ তাহমিদ

আমি গল্প লিখতে ভালোবাসি। তাই আজ যে কথাটি বলতে চাইছি, তা সহজ ভাষায় গল্পের আকারে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। ছোটবেলায় এমন একটি আচরণ, যা আমার নিজেকেও পেতে হয়েছিল। বোধ করি, মধ্যবিত্ত পরিবারের কমবেশি সবাইকেই এমন একটি অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়।

ধরা যাক, এই গল্পের পাত্রের নাম নিশু। তৃতীয় শ্রেণির একজন ছাত্র। কোনো এক চমৎকার সন্ধ্যায় নিশুদের বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটল। হাসিঠাট্টার পর শুরু হলো আড্ডা। ঠিক এমন সময় নিশুর বাবা তাকে আলাপের মাঝে ডেকে নিলেন। ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। অতিথিরও একজন ছেলে আছে, কিংবা মেয়ে। স্কুলে কার পড়াশোনা কেমন চলছে, কোন বিষয় ভালো লাগে, কোন বিষয়ে কে কত নম্বর পাচ্ছে ইত্যাদি কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই নিশুর বাবা বলে উঠলেন, ‘যাই বলুন, ভাই। আপনার ছেলে সোনার টুকরো ছেলে। এমন ছেলেকে নিয়েই তো বাবা-মায়ের গর্ব। আর আমার নিশুটাকে দেখুন। একদম পড়াশোনা করে না। এত করে বলি অঙ্কে মনোযোগ দিতে। মাথায় কিচ্ছু নেই!’ 

কথাটা শোনার সাথে সাথে একদম কুঁকড়ে গেল নিশু। চোখ তুলে কারও দিকে তাকাতে পারছে না। এদিকে অতিথির সাথে আসা ছেলেটি নিশুর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। নিশু ছোট্ট একজন মানুষ, তবে এই বয়সে তার মাঝেও যে আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে, তা যেন কারও মাথায়ই নেই। একবার চোখ তুলে বাবার দিকে চাইলো ও। সত্যিই কি ওর মাথায় কিছু নেই? তবে যে শিক্ষকেরা ওর আঁকা ছবির খুব প্রশংসা করেন? ওর গল্পে লেখা কল্পনাশক্তির বাহার দেখে অবাক হয়ে যান? এসব কি মিথ্যে? আর ভাবতে পারল না নিশু। চারপাশে কী কথা হচ্ছে, তা যেন ওর খেয়ালেই নেই। পুরোটা সময় আপন খেয়ালে ডুবে রইল। 

নিশুর বাবা হয়ত জানেন না, সেদিনের ছোট্ট এই কথাতেই তার ছেলের মানসিকতায় কতটা পরিবর্তন হয়েছে। নিশু এখন আর আগের মতো চমৎকার ছবি আঁকে না, ছোট্ট প্যাডখাতায় মনের খেয়ালগুলো সুন্দর করে লিখে রাখতে পারে না। সে এখন ব্যস্ত অংকে মনোযোগী হতে, কিংবা পরীক্ষায় ভালো নম্বর তুলে বাবা-মায়ের মন ভরাতে। যে নিশু হয়তবা হতে পারত জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতানের মতো শিল্পী, যে নিশু পারত চমৎকার সব গল্প লিখে পাঠকের আনন্দের খোরাক জোগাতে, সেই নিশু-ই হুট করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। 

সত্যিই কি হারিয়ে গেল? সেটা হয়ত সময়ই বলে দেবে। হতেই পারে নিশু সময়ের সাথে সাথে নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারবে, কিংবা পারবে না। হয়ত সে একদিন ডানা মেলে আকাশে উড়বে কিংবা যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে একজন গড়পড়তা মানুষ হয়ে জীবন কাটাবে। ভবিষ্যতের কথা আমিও জানি না, আপনারাও হয়ত জানেন না। শুধু এটা জানি, এই গল্পের নিশু কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। আমাদের চারপাশে এমন হাজারো নিশু আছে, যারা একটু যত্নের অভাবে অকালেই ঝরে পড়ে। আমাদের জানাও হয় না যে কত অমিত সম্ভাবনাময় একটা কুঁড়িকে কীভাবে আমরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি।

এবার তবে আসি নিশুর মতো কোনো শিশুর পরিণতি যদি না চাই, তাহলে আমাদের কী করতে হবে। খুবই ছোট তিনটি পরামর্শ দিচ্ছি, তবে বেশ কার্যকরী। অন্তত সন্তানের মানসিক বিকাশ সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করতে এগুলো অনুসরণ করা অত্যন্ত দরকারি। 

১) কেবল পড়াশোনার খোঁজই নয়, আপনার সন্তান সৃজনশীল কাজে কতটা মনোযোগী এবং পারদর্শী, সেদিকেও খেয়াল রাখুন। তাকে জিজ্ঞেস করুন তার শখ কী। সে শখ অনুযায়ী যত্ন নেয়ার ব্যবস্থা নিন। সন্তান যদি গান গাইতে আগ্রহী হয়, তবে তাকে উৎসাহ দিন। সে যদি ছবি আঁকতে পছন্দ করে, তবে তাকে ছবি আঁকার খাতা কিংবা রঙ পেন্সিল এনে দিন। সন্তানের আঁকা ছবি বাঁধিয়ে এনে দেয়ালে ঝুলিয়ে তাকে চমকে দিন। সন্তানের লেখা ছোট গল্প পরিবারের সবাইকে নিয়ে শোনার আসর করুন। বোঝান যে, হ্যাঁ, তোমার এই গুণটি আমরা পছন্দ করি। তুমি এগিয়ে যাও। যত কিছুই হোক না কেন, পরিবারকে তোমার পাশে পাবে। 

২) পরিবারের সবাই একসাথে মিলে অন্তত একদিন সন্তানকে আসরে মধ্যমণি হিসেবে রাখুন। তার আঁকা ছবি দেখুন, তার গলায় গান শুনুন, তাকে গল্প বলতে উৎসাহিত করুন। আপনার দেয়া ছোট একটা হাততালি কিংবা প্রশংসাসূচক বাক্যই হয়ত তাকে আরও বহুদূর যেতে উৎসাহিত করবে। 

৩) বাড়িতে আসা অতিথির সামনে কখনোই নিজের সন্তানের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরবেন না। তাকে নিয়ে অনুশোচনা করবেন না। বরং তার ভালো দিকগুলো তুলে ধরুন অতিথির সামনে। শিশুরা আহামরি প্রশংসা কখনোই চায় না। তারা চায় অন্তত তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অমিত সম্ভাবনাকে কেউ চিনুক, জানুক। সেগুলো নিয়ে কথা বলুক। এতটুকু করলেই তারা যে নিজেকে নিয়ে কোথায় যেতে পারে, সে সম্পর্কে হয়ত আমাদের ধারণাই নেই। 
আজ তাহলে এপর্যন্তই থাক। হাঁটি হাঁটি পা পা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আজকের শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ- এই বাক্যটি আমরা সবাই জানি। শুধু যা ভালোভাবে জানি না, তা হচ্ছে এই ভবিষ্যতের বুনিয়াদ গঠনে আমাদের কী করতে হবে। 

প্রক্রিয়াটা তবে আজ থেকেই শুরু হোক? 
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন। 


রবি, ২৫ অক্টো ২০২০, দুপুর ২:৩৭ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ