সন্তানদের স্ক্রীন আসক্তি থেকে রক্ষা করুন এবং স্ক্রীনটাইমকে তাদের বিকাশে কাজে লাগান

সন্তানদের স্ক্রীন আসক্তি থেকে রক্ষা করুন এবং স্ক্রীনটাইমকে তাদের বিকাশে কাজে লাগান

আকলিমা শারমিন

দুদিন আগে, এক ঘন্টার জন্য দেখা করতে গেলাম এক পরিচিতর বাসায়। আমাদের সাথে আরও এক পরিচিত ছিলেন, তাদের চার বছর বয়সী ছোট শিশুকে নিয়ে। শিশুটি কিছুক্ষণ গাড়ি নিয়ে খেলার পর বলতে থাকল, সে টিভি দেখবে, কেন এই বাসায় টিভি নেই। দু’বছরের ছোট আমার মেয়েও মোবাইল ফোন এবং টিভি দেখার জন্য পাগল। এই বয়সী সব শিশুরা কোন না কোনভাবে এইসব প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পরে। খুব সচেতন হবার পরও আমরা, আমাদের মেয়েকে মোবাইলের আসক্তির হাত থেকে মুক্ত রাখতে পারিনি। এর মূল কারণ কিন্তু আমাদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এ যুগে প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক কথা। আমরা প্রতিনিয়তই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছি আমাদের শিশুদের সামনে। আমরা বড়রা যখন ব্যস্ত থাকি তখন তাদেরকে ব্যস্ত রাখি মোবাইল ফোন, ট্যাব অথবা টিভি দিয়ে। এভাবেই শিশুদের প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি বাড়ে। একা একা শিশুদের বড় করা মা-বাবার জন্য আরও কঠিন। বিভিন্ন গবেষণায় শিশুদের স্ক্রীন (screen) এর সময় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়ে থাকে, কারণ  স্ক্রীন-টাইম বা পর্দায় কাটানোর সময়টুকু শিশুর জন্য কখনোই পুরোপুরি ভাল নয়। আবার এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে শিশুদের এইসব ডিভাইস থেকে দূরে রাখাও কঠিন। অন্যদিকে এটিও প্রমাণিত, এইসব প্রযুক্তি শিশুদের শিখনকেও  তরান্বিত  করে যদি সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে তার ব্যবহার করা হয়। ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলোর ওপর যেমন অনেক গবেষণা হয়েছে, তেমনি প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের শিখনকে কিভাবে স্থায়ী ও টেকসই করা যায়, তা নিয়েও অনেক গবেষণা আছে। প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে, শিশুদের বিকাশে কিভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত উপায়ে করা যায় সেটাই মূলত এই লেখার উদ্দেশ্য। অবশ্যই এই আলোচনা আমার নিজের পেশাগত, আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই করা। 

আগেই বলেছিলাম, আমার মেয়ের আসক্তির কথা। আসক্তি নিয়ন্ত্রণ আমরা কিভাবে করেছি তার আগে বলি কেন তার মধ্যে এই আসক্তি তৈরি হল। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা আমার নিজের শখ, নানাভাবে আমি প্রযুক্তি নির্ভর। এই নির্ভরতা আমার মেয়ে প্রতিনিয়ত দেখছে। আমি খুব সচেতনভাবে লক্ষ্য  করেছি, আমি যদি মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ আমার মেয়ের সামনে ব্যবহার না করি তাহলে সেও মোবাইলের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। যখন আমি ব্যবহার করা শুরু করি তখন তারও এর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু দু’বছরের ছোট শিশুরা অনেক কিছুই বলে বা বুঝিয়ে প্রকাশ করতে পারে না, তাই তারা ভাব প্রকাশে ব্যর্থ হলে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করে। এই কান্নাকাটির কারণ অনেকসময় মা-বাবা হয়ে আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না। সেটা বোঝার চেষ্টা না করে, আমরা হয়তো তাকে শান্ত করার জন্য হাতে মোবাইল দিয়ে দেই অথবা টিভিটা চালু করি। এভাবেই শিশুর আকর্ষণ বাড়ে। এগুলো হল খুব সাধারণ কিছু উদাহরণ, চিন্তা করলে দেখা যাবে এমন আরও অনেক ছোট ছোট কাজ আছে, যা আমাদের অজান্তে শিশুদের বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আকর্ষণ বাড়াচ্ছে। প্রতিটি শিশুই আলাদা। কাজেই আপনার শিশু কিভাবে, কোন কাজের মাধ্যমে মোবাইল, টিভি বা ট্যাবে আসক্ত হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করতে পারলে, তার আসক্তি নিয়ন্ত্রণের উপায় নির্ধারণ করা সহজ। 

এবার বলা যাক, আমারা কীভাবে চেষ্টা করছি আমাদের মেয়ের এই আসক্তিটাকে নিয়ন্ত্রণ করার, সেই কথায়। কানাডিয়ান পেডিয়াট্রিক সোসাইটির মতে, প্রথমেই অভিভাবক হিসেবে আমাদের নিজেদের স্ক্রীনের সময় কমাতে হবে, বিশেষ করে যখন শিশুরা আমাদের আশেপাশে থাকবে। এই অভ্যাসটা আমরা নিজেরা অনুসরণ করার ফল হাতেনাতে পাওয়া গেছে। দিনে একটা সময় আমরা তাকে টিভি দেখতে দেই, কিন্তু সেটা আসলে কখন তা নির্দিষ্ট করি না। কখনো এটা ৩০মিনিট, কখনো হয় ৪০মিনিট। এটা নির্ভর করবে শিশুদের প্রতিদিনকার রুটিনের ওপর। আপনার শিশুর দৈনিক কর্ম-তালিকার ওপর নির্ভর করে আপনি কখন, কিভাবে তাকে টিভি দেখতে দেবেন অথবা দেবেন না। এরপরের যে কাজটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তা হলো টিভি বা অন্য স্ক্রীন দেখার সময় শিশুর পাশে বসে তাকে ব্যাখ্যা করা। শিশুরা যদি ছড়া-কবিতা দেখতে থাকে তাহলে তার সাথে বসে তা বলা। এতে তার কথা বলার অভ্যাস যেমন বাড়বে, তেমনি শব্দ-ভাণ্ডারও তৈরি হবে। একা একা বসে দেখতে শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই নানান রং-এর অ্যানিমেশনে অনেকটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পরে। পাশাপাশি কি দেখবে এটা ঠিক করাও জরুরি। ছোট একটা উদাহরণ দেই, শিশুদের দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস করানো খুব কঠিন একটা কাজ। যখন শিশুদের এই অভ্যাস করানোর সময় হবে, তখন ব্রাশ করা সম্পর্কিত ছড়া-কবিতা শিশুকে দেখালে এবং ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে শিশুরাও এই কাজটা আগ্রহের সাথে করবে। আমার মেয়ে যখন চুল আঁচড়াতে দেয় না, আমি তখন চেষ্টা করি চুল আঁচড়ানোর দু’লাইন ছড়া তাকে শোনাতে। সবসময় এটা কাজ করে তা না, তবে মাঝে মাঝেই ছড়া শুনে সে ভদ্রভাবেই চুল আঁচড়াতে দেয়। এইরকম করে, শিশুর যে বয়সে যে অভ্যাসটা আপনি করাতে চান, সে সম্পর্কিত ছড়া এবং কবিতা খুঁজে বের করে তাকে দেখিয়ে, সে অভ্যাস আয়ত্ত করা যেতে পারে। এটা হল, দ্বিতীয় উদারহণ। এভাবেই আপনি শিশুর স্ক্রীনের সময়টাকে সঠিকভাবে তার আচরণ গঠনে ব্যবহার করতে পারেন এবং আসক্তিটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

ছবিঃ Getty Images


সোম, ১৬ নভে ২০২০, রাত ১২:৫০ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ