লোকের ভয়ে নয়, নিজের তাগিদেই ভাল মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক সন্তান
ফারাহ মেহরীন
মেরিনা তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছে তার ইচ্ছে অনিচ্ছে খেয়াল খুশীর উপর যতবারই “না”আরোপ করা হয়েছে তার বেশীর ভাগ কারণ হিসেবে মা বলেছে "লোকে খারাপ বলবে"। সে যখন প্রশ্ন করেছে, লোকে খারাপ বললে কি হয়? তখন তার মায়ের উত্তর ছিল, “সেটা তুমি বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেই বুঝতে পারবে; যতদিন সেইসব বোঝার মত বয়স না হচ্ছে ততদিন আমার বারণ শুনে চল।“ মেরিনা তখন খুব অনিচ্ছায় তার ইচ্ছেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে মায়ের কথা মেনে নিত, কারণ ছোটবেলায় তার এই খারাপ বলা লোকগুলোকে খুব ভয় লাগত। সে ভাবতো ওরা বোধহয় চোর ডাকাত গোছের কেউ যারা আড়াল আবডাল থেকে ওকে ফলো করছে খারাপ বলার জন্য।
বড় হতে হতে যুক্তি বুদ্ধি অভিজ্ঞতা দিয়ে মেরিনা যেমন বুঝেছিল যে অন্যকে খারাপ বলে বেড়ানো লোকজন দুরের কেউ না, তারই আশেপাশের মানুষ। তেমনি এটাও বুঝেছিল সেইসব লোকদের সত্যিকার অর্থে ভয় পায় তার মা। কারণ, এইসব লোকদের সবথেকে পছন্দের বিষয় মেয়েদের নিয়ে গসিপ করা, খুব সহজেই এরা ধান কে পান বানিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। সেজন্যই, এই জটিল লোকসমাজের কাছে নিজের মেয়ের ভাল ইমেজ রক্ষা করার ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি রকমের সচেতন ছিলেন। সবকিছুই সে বোঝে। কিন্তু মায়ের কথা মত চলে ভাল মেয়ে টাইটেল পেয়েও সেই সাফল্যে মেরিনার এমন কি ভাল হল এটাই শুধু সে বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, এই ভাল মেয়ে ইমেজ নিয়ে তথাকথিত লোকসমাজে গ্রহণযোগ্যতা হয়তো তার মায়েদের আমলে সাবেকী স্টাইলে ঘটক দিয়ে ঘটকালি করে বিয়ে দিতে কাজে লাগতো, কিন্তু এই আমলে মেরিনা যেই সামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় হয়েছে সেখানে কোন কাজেই লাগে না; উল্টো আরও ক্ষতিই হয়।
মেরিনা একাউন্টিংয়ে খুব ভাল ছিল। তাই ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি তার এক প্রফেসরের পরামর্শে ICMA-তে Cost and Management Accountant (CMA) হওয়ার জন্য প্রফেশনাল ডিগ্রী নেওয়া শুরু করেছিল। খুব ভাল রেজাল্ট করে একটা লেভেল পাশও করে গেছিল। এমন সময় কোন এক লোক জরুরী ভিত্তিতে তার মাকে জানালেন যে , ICMAতে নাকি ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে যায় না, ওরা ওখানে যায় প্রেম করতে। সেই বিষয়ে উনি গল্প শুনেছেন। সেগুলো এমন ভাবে উপস্থাপন করলেন যে সাথে সাথে মেরিনার মা তার ICMAতে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন। মেরিনা খুব চেষ্টা করেছিল তার মাকে বোঝাতে যে, ১৯৯৮ সনে এসে কেউ এমন প্রাচীনপন্থী চিন্তা করে না। বাস্তবতা যে পুরো ওরকম না বা মেরিনা যে সেরকম কিছু করছে না তার মা সবকিছু ভালমতো বুঝলেও যেস্থানে যাওয়া নিয়ে লোকসমাজে নেগেটিভ ধারনা আছে উনি সেখানে মেয়েকে পাঠাতে রাজী না। পরবর্তীতে মেরিনা অস্ট্রেলিয়াতে যেয়ে মাসের পর মাস কফি শপে কাজ করতে করতে আর নতুন করে একাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করার প্রস্তুতি নিতে নিতে বহুবার ভেবেছে-তার যদি CMA ডিগ্রীটা থাকতো তবে পছন্দমাফিক একটা কাজ পাওয়া কতই না সহজ হয়ে যেত। এরকম মেরিনার নিজের বহু উপলব্ধি আর তার মত ভাবে যারা বড় হয়েছে সেরকম অনেকের গল্প শুনে ওর সন্দেহ লোকের এই খারাপ বলাটা আসলে মেয়েদের যোগ্যতা আর আত্মবিশ্বাসকে কমিয়ে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র। মেরিনা কোথাও একটা কবিতা পড়েছিল,
"যার ভয়ে ভীত তুমি
সে তোমার ছায়া ভীরু তোমার চেয়ে"
লোকের কথাকে ভয় না পেয়ে এই কবিতার মত চিন্তাধারায় তার বড় হওয়া উচিত ছিল।
মেরিনার মেয়ে ফারমিনা কখনো "লোকে খারাপ বলবে" বলে কিছু তার মায়ের কাছে শোনেনি। আর সে দেশের বাইরে যাদের সাথে বড় হয়েছে তারা তো দুরের কথা তাদের আগের তিন প্রজন্মের কেউ লোকের খারাপ বলাকে কখনো ভয় পেয়েছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু ফারমিনা যেই সমাজে বড় হচ্ছে সেখানে নতুন প্রজন্মের বেশীর ভাগ ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছুটা বিপরীত ধর্মী একটা সমস্যা মেরিনার চোখে পড়ল। এখনকার বেশীর ভাগ কিশোর-কিশোরী কাউকে ভয় তো পায়ই না, বরং আচার-আচরণে অত্যন্ত উগ্রভাবে যেই কথাটা প্রকাশ করে তা হল "I don't care"। আমি কিছুই কেয়ার করিনা ভাব নিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করাকে তারা স্মার্টনেস বলে মনে করে, আর অন্যকে প্রভাবিত করে তাদের দলে যোগ দিতে। মেরিনার ওদের দেখে দুশ্চিন্তা শুরু হয় তার মেয়েও না ওরকম হয়ে যায়, কারণ অন্যকে খুব কেয়ার করে চলার শিক্ষা তো সেই নিজেই তার মায়ের মত করে মেয়েকে দেয়নি।
মেরিনার মনে হল, তার মায়ের শিক্ষার মত লোকের খারাপ বলাকে ভয় দেখিয়ে তথাকথিত লোকসমাজের কাছে তাদের শর্ত অনুযায়ী ভাল হওয়ার জন্য দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না করলেও একটা সন্তানকে ভাল মানুষ হিসেবে বড় করার জন্য কোথাও তাকে দায়বদ্ধ করা উচিত। যাতে সে কি কেয়ার করা উচিত আর কি উচিত না তার সঠিক দিকনির্দেশনা পায়। মেরিনা তার হাসবেন্ড দুইজন মিলে আলোচনা করে ফারমিনাকে বুঝিয়েছে “আমি নিজে একজন ভাল মানুষ হব এবং যে কোন পরিস্থিতিতে ভাল গুণের চর্চা করবো” এই প্রতিজ্ঞাটা তার নিজের কাছে নিজেরই করা উচিত। পরবর্তীতে তাদের তিনজনের ধারাবাহিক আলোচনার একটা বিষয় হল-কারা ভাল মানুষ তারা কি করেছে, তাদের কি কি গুণ আছে। সাথে সাথে ফারমিনার কোন গুণগুলো আছে আর কোনগুলোর উপর তাকে আরও কাজ করতে হবে। এসব বিষয়ের উপর বিভিন্ন লিঙ্ক ওকে দিয়েছে পড়ার জন্য। অনেক সময় সেসব পড়ে ফারমিনা দুষ্টুমি করে বলেছে, “আম্মু এই গু্ণগুলো কিন্তু তোমারও একটু কম আছে। মেরিনা তখন বলেছে, “ঠিক আছে আমিও আরও ভাল হওয়ার চেষ্টা করছি, তুমিও কর। দেখা যাক কে বেশী ভাল হতে পারি।“ ফারমিনার ভাল বন্ধু হয়ে ওর প্রতিদিনের গল্প শুনে আর মেরিনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ওকে কনফিডেন্স আর সাহস দিয়েছে; যেন সে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য নিজের ভাল সত্ত্বাকে কখনো বিসর্জন না দেয়।
.মেরিনা চায় তার মেয়ে কোন তথাকথিত খারাপ বলা লোকের ভয়ে, লোককে দেখানোর জন্য বা পূর্ব-পশ্চিম কোন সমাজেরই সেট করা ষ্ট্যাণ্ডার্ডে না, নিজের আনন্দেই ভাল মানুষ হিসেবে সুখে থাকতে শিখুক আর তার আশেপাশের মানুষের মধ্যে সেই good vibes ছড়িয়ে দিক।
ছবি: © মোঃ মইন উদ্দিন/শিশুরাই সব
রবি, ২ আগ ২০২০, রাত ১:৪১ সময়
Login & Write Comments