সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন

সন্তানের পড়াশুনা নিয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন

ফারাহ্‌ মেহ্‌রীন

ষোল বছরের ছেলে জিসানের উচ্চশিক্ষা আর ক্যারিয়ার বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে ফারিয়ার ভুমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে সে খুব চিন্তিত। সমস্যা হল এক্ষেত্রে তার এবং তার স্বামী হাসানের মতামত ভিন্ন।

হাসান ছেলের পড়াশুনা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই সচেতন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ব্যাপক ব্যবহার বছর বিশেক পর ২০৪০ সালের দিকে চাকরির বাজারকে পাল্টে দিবে। সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে  ওকে কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঙ্গিনিয়ারিং (সিএসই) পড়ানোই সবদিক থেকে ভাল হবে বলে অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করেছেন। এই কথা মাথায় রেখে ছোট থেকেই তিনি জিসানকে রোবটিক্স, কোডিং আর প্রোগ্রামিং কোর্স করিয়েছেন। পাশাপাশি ও লেভেলের ইলেকটিভ বিষয়গুলোও তিনি সেভাবে সিলেক্ট করে দিয়েছিলেন এবং ছেলের রেজাল্টও তার আশানুরূপ হয়েছে।

সবকিছু ঠিকমতই যাচ্ছিল, কিন্তু সমস্যাটা শুরু করল জিসান তার এ লেভেলের সাবজেক্ট চয়েসের সময়। আচমকা সে তার বাবা মাকে যা বলল তার সারমর্ম হল, ছোটবেলা থেকে পড়াশুনায় তার একমাত্র আনন্দ ছিল ভাল নম্বর পেয়ে বাবা মাকে খুশি করা, কারণ সেই খুশিতে উনারা সবসময় ওর পছন্দের জিনিস কিনে দিত।  কিন্তু ও লেভেল করার সময় একটা বিষয় পড়তে গিয়ে সে পড়াশুনার আসল ইন্টারেস্টটা কোথায় তা খুঁজে পেয়েছে। সে তার বাবার ইচ্ছায় ইলেকটিভ সব সাবজেক্টের পাশাপাশি একমাত্র হিস্ট্রি (ইতিহাস) নিয়েছিল তার প্রিয় এক শিক্ষকের বুদ্ধিতে। হিষ্ট্রি পড়তে এতই ভাল লেগেছে যে সে উপলব্ধি করেছে পছন্দের বিষয় জানার মধ্যে এমন একটা আনন্দ অন্তর্নিহিত আছে যা বস্তুবাদী আনন্দের থেকে  অনেক গভীর। তাই পরীক্ষার পর বিভিন্ন বিষয়ের উপর পড়ে সে মনে করছে যেসকল বিষয়ে তার আগ্রহ সেগুলোর সমন্বয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন (আইআর) পড়াটা তার জন্য খুব উপযুক্ত হবে। তাই সে এ লেভেলে ওই রিলেটেড বিষয়গুলো নিতে চায়। তারপর পড়াশুনা শেষ করে তার পলিটিকাল এনালিস্ট হিসেবে কাজ করার ইচ্ছে যেমনটা হাসানের প্রিয় সিএনএন হোস্ট ফরিদ যাকারিয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। জিসান তার বাবার মনের অবস্থা বুঝে আরও যোগ করল যে, এই পর্যন্ত এআই সম্পর্কে সে যতটা জেনেছে তার থেকে ওর ধারণা যেসব কাজ ট্যাঁসিট নলেজ দিয়ে করতে হয় তা এআই দিয়ে করানো কখনোই সম্ভব হবে না। হয়তো পরবর্তীতে তাকে কিছু ট্রান্সফারেবল স্কীল ডেভেলপ করতে হতে পারে।

সবকিছু শুনে হাসানের মনে হল ছেলের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করাটা বিরাট ভুল হয়েছে, যার ফলে সে পেশা নির্বাচনের মত একটা জটিল বিষয়ে ছেলেমানুষি আবেগ নিয়ে মতামত দেওয়ার সাহস পেয়েছে। তার মতে এখন জিসানের “ভালোর জন্যই” ওকে ভয় দেখাতে হবে। বলতে হবে ইচ্ছেমত পড়তে চাইলে বাবা মায়ের অর্থের উপর নির্ভরশীলতা ছেড়ে কোন হোস্টেলে থেকে নিজে টাকা আয় করে পড়ুক। হাসানের ধারণা, একথা শুনলে ঠিকই সে ভয় পেয়ে আগের ট্র্যাকে ফিরে আসবে।

এদিকে ফারিয়া তার ছেলেকে চাপ দিয়ে কিছু করাতে কোনভাবেই রাজি নন। কারণ, তিনি নিজে পড়াশুনা করেছেন তার বাবা মায়ের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর জবরদস্তিতে ডাক্তারী পড়তে গিয়ে  তিনি যে মানসিক অশান্তিতে পড়েছিলেন, সেই একই অবস্থা তিনি তার ছেলের সাথে কিছুতেই হতে দেবেন না। তাছাড়া, ফারিয়ার কাছে “যা করছি সন্তানের ভালোর জন্য করছি” কথাটা  খুব আপেক্ষিক বলে মনে হয়। কারণ, তিনি খেয়াল করে দেখেছেন অনেক অভিভাবকেরা ফারিয়ার বাবা মায়ের মত সন্তানের ভালোর জন্য জোর খাটিয়ে তাদের যা বানাতে চায় সেটা হয় নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করার জন্য অথবা সন্তানের সাফল্যের মাধ্যমে সমাজে নিজের সম্মান বাড়ানোর ইচ্ছায়। আবার অনেক অভিভাবক হাসানের মত সন্তানের ভাল মানে বোঝে তাকে যে কোন ভাবে এমন সফল বানানো যেন সে চোখে পড়ার মত অর্থ, প্রতিপত্তি আর প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। আসলে সব অভিভাবকই কোন না কোন ভাবে মনে করেন তারা যা করছেন সন্তানদের ভালোর জন্য করছেন। কিন্তু তারপরও সেই ভালোর জন্য করা অনেক কিছুর চাপ নিতে না পেরে অনেক সন্তানই শেষ পর্যন্ত ড্রাগ নেয়, বিভিন্ন আচরণগত সমস্যায় ভোগে। এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। অথচ এরকম বহু দুঃখজনক উদাহরণ দেখেও অভিভাবকরা তাদের ধ্যান-ধারণা পাল্টানোর কোন প্রয়োজন অনুভব করেন না।

শেষ পর্যন্ত ফারিয়া হাসানকে বললেন, পেশা মানুষের জীবনের কোন গন্তব্যস্থান নয় যে জোর করে পড়াশুনা করিয়ে কিছু একটা হয়ে অর্থ উপার্জন শুরু করলেই সে গন্তব্যে পৌঁছে গেল। বরং এটা একটা  সফর তার বাকি জীবনের জন্য যেখানে সামনে এগিয়ে যেতে হলে প্রতিনিয়ত তাকে নতুন নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য একজন মানুষের তার পেশা নিয়ে উদ্দেশ্য, আবেগ, আনন্দ আর স্বপ্নের সংমিশ্রণ থাকা জরুরী। তাই আভিভাবক হয়েছি এই ক্ষমতার বলে নিজেদের স্বপ্ন জোর করে সন্তানের উপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং তার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তার সিদ্ধান্তের ভালো আর খারাপ দিকগুলো বিবেচনা করতে তাকে সাহায্য করা উচিত। এখন আসলে তাদের দরকার একজন এডুকেশন কাউন্সিলরের কাছে তিনজন একসাথে গিয়ে আইআর পড়া জিসানের জন্য আসলেই কতটা উপযুক্ত হবে সেই বিষয়ে মতামত নেওয়া। তারপর সবাই মিলে গবেষণা করে সবদিক বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো।

আমাদের সন্তানের “ভালোর জন্য” ভবিষ্যতে সে কি হবে তার পাশাপাশি সে অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে সহায়তা করবে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।

ছবিঃ Freepik


সোম, ২ নভে ২০২০, রাত ২:৩২ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ