শিশুর কথা কেন শুনব, কিভাবে শুনব

শিশুর কথা কেন শুনব, কিভাবে শুনব

রাশেদা আক্তার

শিশু তার জীবনের প্রতিটি বিষয়ে মতামত জানাবে এটা তার অধিকার, আর সে মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে শােনা বড়দের দায়িত্ব। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা শিশুর সঙ্গে কথা বলতে হবে, তবেই সে শিখবে। তার কথাও যে গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে সেটা ভাবনাতে আসে খুব কম।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক সনদের অনুচ্ছেদ ১২ তে উল্লেখ আছে: “যেসব শিশুরা নিজস্ব মতামত গঠনে সক্ষম, তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন সকল বিষয়ে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। তাদের বয়স ও চিন্তাশক্তির পরিপক্কতা অনুযায়ী তাদের মতের গুরুত্ব দিতে হবে।”

বাংলাদেশের জাতীয় শিশুনীতি ও শিশুদের মতামত শােনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য শিশুর নিজস্ব চিন্তাধারা গড়ে উঠতে দেয়া খুব জরুরী। তাই বেড়ে উঠার প্রতিটি ধাপে খােলামেলা আলােচনার সুযােগ চাই যেন তার সাথে সম্পর্কিত সব বিষয়ে সে মতামত জানাতে পারে। তবে কেন এবং কিভাবে তাদের মতামত শােনা যায় এই নিয়ে কারাে কারাে ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকের মতে শিশুর কথা শােনা মানে হলাে সব কথা মেনে নেয়া আর সেটা সব সময় সম্ভব নয়। আসলে মতামত দেয়া মানেই তা পুরােপুরি মানতে হবে ব্যাপারটা তা নয়। বয়স ও চিন্তার পরিপক্কতা অনুসারে শিশুর মতামতকে মূল্য দিতে হবে। এছাড়া শিশু স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিও বিবেচণায় নিতে হয়।

কথা শােনার চচা ছােট বয়স থেকে শুরু করতে হবে পরিবারে। পরিবারে মত প্রকাশের পরিবেশ পেলে সমাজের যে কোন স্তরে নিজের ভাবনা প্রকাশের জন্য শিশু তৈরি হতে পারবে। যেমন শিশু যদি পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে এমন কিছু আবদার করে সেটি কি মেনে নিতে হবে ? অবশ্যই না। তবে কেন না সেই কারণগুলাে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে ও এর পরিবর্তে সামর্থ্যের মধ্যে তাকে অন্য কিছু পছন্দ করতে দেয়া যেতে পারে। এই অনুশীলন তাকে বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দিবে। পাশাপাশি চাইলেই সব পেয়ে যাবে এমন ধারনাও তৈরি হবে না। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ তা হলাে শিশুর সঙ্গে অমতের কারণগুলিকে বুঝিয়ে বলা যেন সে সহজে গ্রহণ করে এবং ভুল কোন ধারণা নিয়ে না থাকে।

পরিবারে খােলামেলা আলােচনার পরিবেশ শিশুকে সুরক্ষা দেয়। যেমন বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে বেশ কৌতুহলী হয়ে থাকে । এসময় কি করবে বা করবে না এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভােগে। তখন মা বাবার দায়িত্ব এপ্রসঙ্গে আলােচনার ক্ষেত্র তৈরি করা । তা না হলে সঠিক তথ্যের অভাবে সে বিপদে পড়তে পারে। প্রয়ােজনীয় তথ্য শিশুকে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে এবং নিজেকে রক্ষার কৌশল শিখতে সাহায্য করবে। আমরা দেখেছি শিশুরা কাছের মানুষের দ্বারা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয় কিন্তু ভয় বা লজ্জায় প্রায় এ ব্যাপারে মুখ খােলেনা। সেই সুযােগটি একজন নিপীড়ক কাজে লাগিয়ে থাকে। পরিবারে আলােচনা এই ধরনের ঝুঁকি থেকে শিশুকে সুরক্ষা দিতে পারে। শুধু তাই নয় সঙ্গদোষ কিংবা হতাশা থেকে কিশাের কিশােরীদের মাদকাসক্ত অথবা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। শিশুর সঙ্গে পরিবারের যােগাযােগের ঘাটতি এর অন্যতম কারণ বলা যায়। এর বাস্তব উদাহরণ হলি আর্টিসানের নৃশংস ঘটনা। জড়িত তরুণদের অধিকাংশ মা বাবা হতাশা প্রকাশ করেছিলেন যে, তারা সন্তানের মনের খবর রাখতে পারেননি। পরিবারগুলাের সাথে তাদের দুরত্ব ছিল এটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাই পরিবারে সন্তানের কথা গুরুত্ব দিয়ে শােনা শুধু দরকার নয়, অপরিহার্য।

শিশুর বিকাশে পরিবারের পর বিদ্যালয়ের ভুমিকা সবচাইতে বেশি। সেখানে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বােঝেনা এই ভ্রান্ত ধারনা থেকে সরে এসে পড়াশােনা থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনাতে তাদের মতামত দেয়ার সুযােগ দিতে হবে। ফলাফল শুধু শিশুরাই নয় বরং বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি। পাবে এই কথা শতভাগ জোর দিয়ে বলা যায়। কারণ একটি শিশুই বলবে তার কাছে তার বিদ্যালয় কতটা পছন্দের। এখানে বড় পরিসরে আলােচনার সুযােগ তাকে আত্মবিশ্বাসী ও অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করবে। শিশুর জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরির সময়ও তাদের কথা শােনা দরকার। এর মধ্য দিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তার সমাধানের জন্য শিশুরা সুপারিশ করতে পারবে। বড়দেরকে শিশুর প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সহযােগিতা করবে। পাশাপাশি আইনটির বিষয়ে তারা সচেতন হবে ও নিজেদের আইনি অধিকার সম্পর্কে জানতে পারবে।

বিগত বছরগুলােতে বেসরকারী সংস্থাসমুহে,সরকারের স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে শিশুরা কথা বলছে এবং এর ইতিবাচক ফলাফলও দেখা যাচ্ছে। তারপরও বাস্তবে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশুর অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে অবশ্যই করণীয় অনেক বিষয় আছে যেগুলাে দীর্ঘ আলােচনার দাবী রাখে এবং আলাদা করে লেখারও প্রয়ােজনীয়তা আছে। শিশুর কথা শােনা মূলত একটি প্রক্রিয়া যার ধারাবাহিতা অপরিহার্য-হােক সেটা পরিবারে , বিদ্যালয়ে বা সমাজে। তা না হলে শিশুর বিকাশে এর সুফল পাওয়া যাবেনা। এই বিষয়ে বড়দের পরিস্কার ধারনা থাকতে হবে তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাবে।

আমাদের প্রত্যাশা একটি শিশুবান্ধব সমাজ গড়ে তােলা যেখানে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠবে। শিশুকে বাদ দিয়ে শিশুবান্ধব সমাজ অসম্ভব। সকলকে সব অস্পষ্টতা দুর করে শিশুর কথা শােনার মত করে শুনতে হবে। এই ব্যবস্থা সমাজে টেকসই করার জন্য সরকারকে আরও মনােযােগ দিতে হবে। শিশুর মতামত গ্রহণের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য এটি পরিচালনার মানদন্ড ও নির্দেশনা প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বেঁচে থাকা,উন্নয়ন,সুরক্ষা ও অংশগ্রহণ একে অন্যের পরিপূরক। একটির শূন্যতা আরেকটিকে পিছিয়ে দেয়।
 

ছবি: Child RIghts International Network


সোম, ১৪ সেপ্ট ২০২০, সকাল ৪:৪২ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ