শিশুর প্রকৃতি সংবেদনশীলতা: শিখতে হবে পরিবার থেকে
ফারজানা রহমান
শিশুরা স্বভাবগত ভাবেই তার চারপাশের পরিবেশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে থাকে এবং আশেপাশের পরিবেশ থেকে নতুন কিছু খোঁজার মধ্যে দিয়ে আনন্দ পেতে ভালবাসে। তাদের কৌতূহলী মনের কারনেই , আশেপাশের প্রতিটা ব্যাপার নিয়েই তার মনে ‘কেন’ থাকে, ‘কিন্তু’ থাকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই গর্ভবতী হাতি যখন বিস্ফোরক ভরা আনারস খেয়ে মারা যায়, অনেক শিশুরই সরল মনে ঘটনাটা বিশেষভাবে দাগ কেটে যায় , তারা বড়দের বার বার প্রশ্ন করে, “এটা কেন করা হল ?” সুন্দর সবুজ গাছের পাতা দেখে তাদের মনে হয়, “কেন আমরা এত সুন্দর সবুজ গাছ কেটে ফেলি ?” ঋতুবৈচিত্র্যর স্বাতন্ত্র্যে তাদের মনে হয়, কোনটা বেশি সুন্দর, অঝোর ধারা বৃষ্টির শব্দ, নাকি পূর্ণ চাঁদের রূপালি জ্যোৎস্না । একজন মানুষের শিশুকালই সবথেকে উপযুক্ত সময় শেখবার জন্য, এই সময়ের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা সারাজীবন প্রেরণা দেয়। সেজন্যই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে জানা এবং এর প্রতি যত্নবান হবার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই করবার জন্য শিশুদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে।
পরিবার থেকে অনুপ্রেরণা
পরিবারই শিশুর প্রথম এবং সারাজীবনের জন্য মূল্যবান একটি প্রতিষ্ঠান । শিশুদেরকে প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীল হবার জন্য বাবা-মাকেই এগিয়ে আসতে হবে। কৌতূহল আনবার জন্য শিশুর একান্ত জগতে প্রকৃতির আবেশ তৈরি করবার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
১) শিশুর নিজস্ব জগৎ:
শিশুকাল থেকেই একজন মানুষের নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়, সেই জগতে সে তার কল্পনায় ভাসতে ভালবাসে, সে নিজ মনে গান করতে ভালবাসে, কখনও বা সে আনমনে বসে বৃষ্টি দেখে, বৃষ্টির পানির ফোটা যখন বারান্দার গ্রীলে লেগে থাকে, সেগুলা দিয়ে সে খেলতে পছন্দ করে, পাখির কিচিরমিচির শুনতে তার ভাললাগে, অথবা আনমনে রঙ নিয়ে খেলতে সে পছন্দ করে। আমরা অনেক সময়ই শিশুর এই জগতটাকে অবহেলা করি কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখা উচিত, এই একান্ত সময়টা খুবই মূল্যবান এবং এখান থেকেই বের হয়ে আশে তাঁর সৃষ্টিশীল বাক্তিত্ব । তাদের আপন জগতে সে যেন প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে পারে, সেই সময় ও সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে ।
২) বই পড়ার রেওয়াজ:
বই পড়ার কোন বিকল্প নেই, পরিবারে বই পড়ার রেওয়াজ তৈরি করতে হবে । ঘরের মধ্যে ছবিসহ বই, ম্যাগাজিন রাখতে হবে যেখানে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণিজগৎ ও তাদের বাসযোগ্য পরিবেশ সম্বন্ধে সুন্দর ও সাবলীল বর্ণনা থাকবে। ছোটবেলা থেকেই শিশু যদি ঘরের মধ্যেই এই ধরনের বই দেখে এবং বাবা-মাকে আলোচনা করতে শোনে তাহলে তার এই বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে ।
৩) ঘরে প্রকৃতির ছোঁয়া:
বাসার বারান্দা, সিঁড়ির কোনা, ঘরের বিভিন্ন জায়গাতে ছোট ছোট গাছ রাখা যেতে পারে এবং শিশুদের সঙ্গে নিয়ে পরিচর্যা করলে, অবশ্যই গাছের প্রতি তাদের একটা মমতা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হবে।
৪) ছাদ হতে পারে ছোট্ট একটি উঠান:
যাদের সুযোগ আছে তাঁরা ছাদ-বাগান করতে পারেন, ছাদ হতে পারে বাসার ছোট্ট একটি উঠান । ছাদ-বাগানের মধ্যে দিয়ে শিশুরা গাছের চারা রোপণ, বেড়ে ওঠা, ফুল-ফল আসা, ফল তোলা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পাবে এবং তখন সে খাবারের উৎসের প্রতি আগ্রহী হবে । ছাদের বিভিন্ন কোনায় পাখির জন্য খাবার আর পানির বাবস্থা করা যেতে পারে, বাচ্চারা যখন নিজ হাতে পাখির জন্য খাবার ও পানির বাবস্থা করবে, তখন তার মমতা অনেক বেড়ে যাবে ।
৫) ঋতু বৈচিত্র্যর উপভোগ করবার আনন্দ:
আপনার শিশুকে রঙময় ঋতু বৈচিত্র্য উপভোগ করতে দিন । বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে অনুমতি দিন, বিভিন্ন ফুলের গন্ধ, রঙ সব চিনতে নিজেদের বেড়ানোর পরিকল্পনা প্রকৃতির মাঝে করুন । কোকিলের ডাক, পাখির কলতান যখন সে শুনবে, বাবা-মা হিসাবে আপনিও মৌন সঙ্গী হয়ে তাকে সঙ্গ দিন । তার ভাললাগাকে উপলব্ধি করুন ।
৬) সংযমী এবং সংবেদনশীল হবার অভ্যাস:
পারিবারিক শিক্ষা শুরু হয় বাবা-মায়ের আচার -ব্যাবহার থেকে । তাই, এইখানে বাবা-মা কিছু নিয়ম মেনে চললে শিশুরা আপনা থেকেই বাবা-মাকে অনুসরণ করবে। যেমন -
ক) প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলেই বাতি নিভিয়ে দিতে হবে।
খ) দাঁত ব্রাশ করবার সময় কল বন্ধ রাখতে হবে।
গ) গোসল/স্নানের ক্ষেত্রে অল্প সময় নিতে হবে।
ঘ) সাবান ব্যাবহারের সময় কল বন্ধ রাখতে হবে।
ঙ ) পানির কাজ শেষ হবার পর কল বন্ধ করতে হবে।
চ) গ্লাস বা বালতির অতিরিক্ত পানি কখনোই ফেলে দেওয়া যাবে না, এই পানিই বাগানের অথবা ঘরের গাছের পরিচর্যার কাজে লাগানো যেতে পারে।
ছ) বাসায় গাছ থাকলে নিয়মিত পানি দিতে হবে এবং পরিচর্যা করতে হবে ।
৭) প্রাণিজগতের প্রতি সংবেদনশীল হবার মানসিকতা :
অনেক সময়ই দেখা যায় বিভিন্ন ভাবে কুকুর বা বিড়ালের সাথে মানুষ খারাপ ব্যবহার করে, কখনও চোখের সামনে পড়ে গেলে শিশুদের বোঝাতে হবে এটা ঠিক হচ্ছে না ।
৮) প্রকৃতি থেকে শিক্ষা :
কোন গাছের পাতা কেমন, কোন ফুল কখন ফোটে, কোন মৌসুমে কোন ফল পাওয়া যায়, এই বিষয়বস্তু আলোচনাতে রাখতে হবে। ফাল্গুন মাসে প্রকৃতি যখন ফুলে ফুলে সেজে ওঠে, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্য ।
আসুন, আমরা সবাই মিলে পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল হবার অভ্যাস গড়ে তুলি । আমরা আমাদের শিশুদের মনের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি এবং তার সকল প্রাণীর প্রতি মমতার আবেশ তৈরি করি।
আমাদের মনে রাখতে হবে,
“মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই পরিবেশ টিকিয়ে রাখা খুব জরুরী। আমরা যদি পৃথিবীর যত্ন নেই, তাহলে পৃথিবীও আমাদের যত্ন নিতে পারবে।”
ছবি: নাসির খান সৈকত/ শিশুরাই সব
রবি, ২ আগ ২০২০, রাত ১:৫২ সময়
Login & Write Comments