একজন শিশুকে আরেকজনের সাথে তুলনার আগে তার সুদুরপ্রসারী ফলাফল ভেবে দেখেছেন কি?
ফারাহ্ মেহ্রীণ
লিসা প্রথম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে দেখে ওর মায়ের চোখ প্রায় কপালে উঠে যাওয়ার মত অবস্থা। উনি মেয়েকে প্রশ্ন করলেন তাদের ক্লাসে যে প্রথম হয়েছে সে দেখতে কেমন? লিসা যখন শায়লার (যে মেয়েটি প্রথম হয়েছে) চেহারার কোন অংশ থেকে বর্ণনা শুরু করবে ভাবছিল তখন তার মা চিৎকার দিয়ে বললেন, “আমি জানতে চাচ্ছি তার মাথায় কি দুইটা শিঙ আছে নাকি তার চারটা চোখ আছে যে সে ফার্স্ট হল আর তুমি হতে পারলে না?”
এই ধরনের কথাবার্তার সাথে আমরা অনেকেই হয়তো পরিচিত এবং আমরা জানি অভিভাবকরা সন্তানদের মনে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে এভাবে কারো সাথে তুলনা করে নেতিবাচক মন্তব্য করে না। তাদের আসল উদ্দেশ্য হল এই ধরনের তুলনার মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব সৃষ্টি করিয়ে তাকে আরও ভাল ফলাফল করতে উদ্বুদ্ধ করা। আর কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় এই পদ্ধতিতে অভিভাবকরা আসলেই সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব তৈরি করতে সফলও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তার ফলাফল কি হয়?
যেমন লিসার গল্পটাই আরেকটু এগিয়ে দেখা যাক। লিসা যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন ক্লাসের সেই ফার্স্ট গার্ল শায়লা ওদের এলাকাতে থাকে এবং তার মা চাকরি করে শুনে লিসার আম্মা উদ্যোগ নিয়ে লিসার সাথে তাকেও স্কুল থেকে আনা নেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওরা নিজেদের বেস্ট ফ্রেন্ড বলে মনে করা শুরু করলো। এর মধ্যে অঙ্কের এক ক্লাস টেস্টে দেখা গেল শায়লা বিশে বিশ, আর লিসা ১৮ পেয়েছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে লিসার আম্মা সেই খবর পেয়ে কেন সে শায়লার চেয়ে কম নম্বর পেয়েছে বলে প্রচণ্ড বকা-ঝকা করার এক পর্যায়ে বললেন এর পরের বার যদি সে কম নম্বর পায় তাহলে উনি লিসাকে শায়লার পা ধোয়া পানি খাওয়াবে। লিসা তার মায়ের কথায় চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে কাঁদছে দেখে শায়লার খুব মন খারাপ হল। এত বকাঝকার পরও যখন লিসা পরের পরীক্ষায় শায়লার থেকে কম নম্বর পেয়েছে দেখল তখন সে শায়লাকে অনুরোধ করলো ওর মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতে যে সে লিসার থেকে কম নম্বর পেয়েছে। যদিও শায়লা মিথ্যা বলতে পছন্দ করতো না কিন্তু তারপরও সে লিসাকে বকাঝকা থেকে বাঁচানোর জন্য ওর কথামত মিথ্যা বলল এবং সেই কথা শুনে লিসার মা যথেষ্ট খুশি হলেন। তারপরের পরীক্ষায় রেজাল্ট নিয়ে ঘটলো সবথেকে মজার ঘটনা। সেবার সত্যিই লিসা শায়লার থেকে এক নম্বর বেশী পেয়ে খুব খুশী। এদিকে শায়লা কম নম্বর পাওয়ায় নিজের কাছে একটু খারাপ লাগলেও লিসা খুশি হয়েছে দেখে বেচারাকে ওর মায়ের কাছে বকা খেতে হবে না বলে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করল। কিন্তু সে আসল ধাক্কা খেলো যখন লিসা উল্টা শায়লার মাকে গিয়ে বলল, “আন্টি আপনি কি জানেন শায়লা অঙ্কে আমার থেকে কম নম্বর পেয়েছে? এখন আপনি ওকে বকা দিবেন না? আমার আম্মা হলে কিন্তু আমাকে অনেক বকা দিত।“
লিসার এরকম কথা এবং সেটা বলার ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি শুনে শায়লার আম্মা ওদের একসাথে যাতায়াত বন্ধ করে তার মেয়ের জন্য স্কুলের মাইক্রবাসের ব্যবস্থা করলেন। আর শায়লাও লিসার সাথে একছত্র বন্ধুত্ব কমিয়ে ক্লাসের অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা শুরু করলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে অন্য অনেক ভাল বন্ধু সে পেয়েও গেল। এদিকে শায়লা লিসার সাথে আর আগের মত বন্ধুত্ব রাখছে না দেখে লিসার প্রতিযোগী মনোভাব প্রতিহিংসায় রূপান্তরিত হল। ওকে নিয়ে অকারণে শিক্ষকদের কাছে নালিশ করা ও কোনকিছু ভুল করলে অন্যদের নিয়ে হাসাহাসি করা লিসার খুব পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল শুধু শায়লা নয় লিসার থেকে যে কেউ কোন বিষয়ে ভাল করলেই তাকে নিয়ে সে সমালোচনা করা শুরু করে দেয়। এই কারণে সে ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে নানা রকম ভুল বুঝাবুঝি আর অশান্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল।
আমরা খেয়াল করলেই শিশুদের এরকম আচরণ আশেপাশে অনেক দেখতে পাই। আর সেই সব শিশুদের দীর্ঘ দিন ধরে খেয়াল করলে এই সব আচরণের পেছনের কারণগুলোও চোখে পরে। যেমন অনেক পরিবারে শুধু স্কুলের পড়াশুনার সাথে সাথে অন্যান্য আরও অনেক বিষয় নিয়ে আভিভাবকরা নিজের এক সন্তানের সাথে আরেক সন্তানেরও তুলনা করে। আর পরবর্তীতে দেখা যায় এক সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্ব ভাইবোনদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ আর দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছে। অথচ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের লেখাগুলি থেকে জানা যায়, ছোটবেলার এই ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার নেতিবাচক ফলাফল শুধু সন্তানদের ব্যক্তিগত জীবনেই না, বরং কর্মক্ষেত্রেও পরে। যেমন ‘গ্রুপ বিহেভিয়ার’ নিয়ে গবেষণা থেকে জানা যায়, যারা অনেক তুলনার মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাবে বড় হয় তাদের গ্রুপ পারফর্মেন্স খারাপ হয়। কারণ তারা দলীয়ভাবে বা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কোন কাজের প্রশংসা পাওয়ার থেকে শুধুমাত্র নিজের অর্জনকে বেশী প্রাধান্য দেয়। এই ধরনের মানসিকতার মানুষের মধ্যে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স কম থাকায় তারা অন্যকে সঠিকভাবে বুঝে তার সাথে সহানুভূতিশীল হয়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মত সামাজিকতা রক্ষাতেও ব্যর্থ হয়।
এদিকে বিখ্যাত লেখক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ক্যারিয়ার কোচ সি্টফেন আর কোভের মতে একজন মানুষের জীবনে সফল হওয়ার জন্য মেন্টাল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তার (IQ) পাশাপাশি ফিজিক্যাল, ইমোশনাল এবং স্পিরিচুয়াল ইন্টেলিজেন্সেরও প্রয়োজন হয়। লিসার মত আমাদের আশেপাশের বহু উদাহরণ খেয়াল করলে দেখা যায় সন্তানের তুলনা করতে গিয়ে তাকে অপনাম করে, লজ্জা দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে তার আচরণকে যেভাবে প্রভাবিত করা হয় তাতে তাদের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের পাশাপাশি স্পিরিচুয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিকাশ প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমার মনে হয় শিশুদের নিয়ে যে কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অন্যদের সাথে তুলনা করার আগে অভিভাবকদের খরগোশ-কচ্ছপ দৌড় প্রতিযোগিতার গল্পটা মনে করা উচিত। খরগোশের প্রথম লাফ দেখে যদি কচ্ছপের অভিভাবকরা তাকেও ওরকম একটা লাফ দেওয়ার জন্য একটা চাপ দিত তাহলে গল্পটা কেমন হত? হয়তো দেখা যেত কচ্ছপ লাফ দিতে গিয়ে উল্টে পরে এক জায়গায় থেমে গেছে। কাজেই সচেতন অভিভাবকের কাজ হল সন্তানকে তার দায়িত্ববোধ শিক্ষা দেওয়া যেন সে দায়িত্বে অবহেলা না করে কচ্ছপের মত ধীর গতিতে হলেও হাল না ছেড়ে এগিয়ে যায়। তুলনা না করে বরং তাদের আরনেস্ট হেমিঙ্গওয়ের এই কথাটা শেখানো উচিত,
“There is nothing noble in being superior to your fellow man; true nobility is being superior to your formal self.”
বৃহস্পতি, ১৯ মে ২০২২, সকাল ৫:২৫ সময়
Login & Write Comments