বইমেলাকে আরও শিশু-বান্ধব করা ও শিশুদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলায় সুপারিশ

বইমেলাকে আরও শিশু-বান্ধব করা ও শিশুদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলায় সুপারিশ

বই পড়ায় শিশুদের আগ্রহী করতে এবং আসন্ন অমর একুশে বইমেলা কীভাবে আরও শিশু-বান্ধব করা যায় সেই লক্ষ্যে “শিশুরাই সব” ও “বইবাড়ি রিসোর্ট” যৌথভাবে বেশ কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। কয়েকজন লেখক, প্রকাশক, উন্নয়নকর্মী ও শিশু অধিকারকর্মীদের মতামতের প্রেক্ষিতে বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি, প্রকাশক, লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের জন্য আলাদাভাবে সুপারিশগুলি তৈরি করা হয়েছে।

বাংলা একাডেমির জন্য

- শিশু চত্বরে প্রবেশের সময় একটা আকর্ষণীয় দরজা বা ফটক রাখা যেতে পারে যার মাধ্যমে শিশুরা একটা আলাদা জগতে প্রবেশের আনন্দ পাবে। সেজন্য শিশুদের বয়সের কথা বিবেচনা করে রঙ, ছবি, ফন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে শিশু চত্বরকে সাজাতে হবে।

- মেলার যেকোনো দরজা দিয়ে ঢোকার পরই শিশু চত্বরে যাওয়ার পথনির্দেশ স্থাপন করা যেতে পারে। সেই নির্দেশনা অন্য সকল নির্দেশনা থেকে দৃশ্যগতভাবে পৃথক, অধিকতর রঙিন ও আকর্ষণীয় হবে হবে।

- স্টলগুলোতে বই প্রদর্শনের স্থান যাতে শিশুর উচ্চতায় থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে।

- যেসব প্রকাশক বড়দের পাশাপাশি শিশুতোষ বইও প্রকাশ করেন, তাঁরা স্টলের একটি অংশ শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করতে পারেন, যেখানে শিশুরা অভিভাবকের সঙ্গে গিয়ে তাদের বই খুঁজতে পারবে।

- শিশু প্রাঙ্গণে এমন এক বা একাধিক জায়গা নির্ধারিত থাকতে পারে যেখানে শিশুরা গল্প পাঠ, গল্প লেখা, আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে সৃজনশীল সময় কাটাতে পারবে।

- বড় শিশুর সঙ্গে মা যে কোলের সন্তানকে নিয়ে আসেন, তার জন্য ব্রেস্টফিডিং কর্নার থাকতে হবে।

- শিশুদের উচ্চতা ‍উপযোগী পানি পানের জায়গা, শৌচাগার ও বেসিনের ব্যবস্থা থাকা দরকার।

- শিশু প্রাঙ্গণের ভেতরে বা তার কাছাকাছি শিশুতোষ বইয়ের লেখকদের জন্য আলাদা লেখক চত্বরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যেখানে শিশুরা তাদের প্রিয় লেখকদের সাথে সময় কাটাতে পারবে।

- মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন শিশুতোষ বই কিংবা পঠিত অন্যান্য বই সম্পর্কে যাতে শিশুরা তাদের মতামত ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে সেজন্য আলোচনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এর ফলে শিশুরা কী ধরনের বই পড়তে আগ্রহী সে সম্পর্কে লেখক ও প্রকাশকরাও ধারণা পেতে পারেন।

- বিভিন্ন নাট্যদলের সহায়তায় শিশুদের জন্য নাটক, পুতুলনাচ, মূকাভিনয় কিংবা অন্য পারফরম্যান্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 

- অমর একুশে গ্রন্থমেলার পাশাপাশি শুধু শিশু-কিশোরদের উপযোগী প্রকাশনা নিয়ে আলাদা একটি মেলা আয়োজন করা যেতে পারে।

- মেলা প্রাঙ্গণে বই ব্যাংক তৈরি করে সেখানে বই দান করার ব্যাপারে মেলায় আগত ক্রেতাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে।

- দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা অপ্রতুল সেখানে বই পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
 

প্রকাশকদের জন্য

- শিশুদের বই প্রকাশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। 

- বইয়ের বিষয়, ভাষা, চিত্র ও ছবি, কাগজ ও ছাপার মান ইত্যাদি বিবেচনা করে শিশুদের উপযোগী ভালো মানের বই প্রকাশ করতে হবে।

- শিশুদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট পাঠকের বয়স অনুযায়ী কাগজের ধরন, বাঁধাই, কাটিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ‍ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে (যেমন পপ আপ বুকস, ম্যাগনেট বুকস, মিরর বুকস)।

- বিভিন্ন ধরনের বই মুদ্রণের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও কারিগরি উৎকর্ষের সর্বোচ্চ ও অভিনব প্রয়োগের আশ্রয় নিয়ে হবে। 

- বাজারে সহজলভ্য নয় এমন শিশুতোষ ধ্রুপদী সাহিত্য পুনর্মুদ্রণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুদের আকর্ষণের জন্য নতুন চিত্রাঙ্কন যোগ করা যেতে পারে।

- বইয়ের দোকানগুলোতে সপ্তাহে একদিন একজন স্টোরিটেলারের অংশগ্রহণে শিশুদের জন্য গল্প উপস্থাপনের আয়োজন করা যেতে পারে। বইমেলার স্টলেও এরকম ব্যবস্থা রাখা সম্ভব।

- শিশুদের বই যারা প্রকাশ করে, বইমেলাতে তাদের স্টলগুলোকে সাধারণ স্টলের মতো না করে অন্য নকশা ব্যবহার করে তৈরি করা যেতে পারে। স্টলের ভেতরে বুকশেলফের পাশে সিঁড়ি রাখা যেতে পারে, যাতে করে শিশুরা বিভিন্ন ধাপে উঠে উঠে সেই ধাপের বইগুলো দেখতে পারে। এতে তারা খেলার মতো আনন্দ পেতে পারে।

- স্টলের একেকটা অংশ বইয়ের বিষয় অনুযায়ী সাজানো যেতে পারে। যেমন, প্রকৃতি বা বন্য পরিবেশ নিয়ে বইগুলোর সামনে গাছপালা, পশুপাখি দিয়ে ঐ ধরনের পরিবেশ বা আবহ তৈরি করা যেতে পারে। এতে শিশুরা সৃজনশীল বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হবে।

- বইমেলায় স্টলে বই প্রদর্শনের জায়গাগুলো শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী তৈরি করতে হবে।

- স্টলগুলোতে একটা বইয়ের কিছু অংশের ইলাস্ট্রেশন দিয়ে দেয়া যেতে পারে যাতে শিশুরা বইটির সারাংশ ইলাস্ট্রেশনের মাধ্যমে দেখে নিতে পারে।

- প্রকাশকরা তাদের প্রকাশিত বইয়ের চরিত্রগুলোকে বইয়ের পাতার বাইরে এনে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পারেন। প্রমাণ আকৃতির চরিত্রগুলো স্টলে এবং স্টলের বাইরে হেঁটে বেড়াবে এবং শিশু ও তার অভিভাবকদের সাথে কথাবার্তা বলবে এবং নানা রকম দুষ্টুমি বা হাসিঠাট্টা করবে। এতে করে শিশুরা শুধু ঐ নির্দিষ্ট চরিত্র সম্পর্কে নয়, বরং অন্যান্য বইয়ের অপরাপর চরিত্র সম্পর্কেও আরো বেশি আগ্রহী হবে। 

- শিশুরা যখন যেকোনো স্টলে যাবে তখন বই বিক্রেতা কিংবা বিক্রয়কর্মীরা তাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবেন। শুধুমাত্র বড়রাই নয়, শিশুরাও ক্রেতা হতে পারে—এ বিষয়টি মনে রাখা রাখতে হবে।

- স্টলগুলিতে “শিশুদের আগে বই দেখতে দিন”—এরকম বাণী লিখে দর্শক, ক্রেতা ও অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে, যাতে তারা স্টলে শিশুদের অগ্রাধিকার দেন।

- শিশুদের জন্য দোকানে ও বইমেলায় পুরনো বই বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

 
লেখকদের জন্য

- বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য ভালো মানের গল্প, ছড়া ইত্যাদি লেখা প্রয়োজন। অনেক অভিভাবকের অভিযোগ, মানসম্মত বই না হওয়ার কারণে অনেক শিশুরা ইংরেজি বই পড়লেও বাংলা বই পড়তে চায় না।

- বিভিন্ন বয়সের শিশুদের অনুভূতি, চিন্তাভাবনা ও পড়ার গতি আলাদা। পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এসব বিবেচনা করেই বই লিখতে হবে। যখন কেউ বই লিখবেন সেটা শিশুর বয়স উপযোগী হতে হবে এবং সে বইকে সময়োপযোগীও হতে হবে।

- বইয়ের বিষয় ও বক্তব্য যেমন খুব ভালো হতে হবে, তেমনি ভাষাও সুন্দর হতে হবে, শিশুর উপযোগী হতে হবে। বানান অবশ্যই শুদ্ধ থাকতে হবে।

- লেখকরা নিয়মিত বইয়ের দোকানগুলিতে কিংবা বইমেলায় শিশুদের সাথে সময় কাটাবেন যাতে শিশুরা তাদের প্রিয় লেখকের সাথে সাক্ষাতের আনন্দ অনুভব করতে পারে।

- শিশুরা কী ধরনের গল্প, ছড়া ইত্যাদি পড়তে আগ্রহী তা জানতে শিশু পাঠকদের সাথে এবং অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করতে হবে। তাদের আগ্রহের বিষয় থেকে পরবর্তী রচনার আইডিয়া তৈরি করতে হবে।

 

প্রচ্ছদশিল্পীদের জন্য

- শিশুদের আকৃষ্ট করে এমন রঙ ও ছবি ব্যবহার করে মানসম্মত সৃজনশীল প্রচ্ছদ তৈরি করতে হবে।

- বইমেলার স্টলে শিশুদের অনেক প্রিয় চরিত্রগুলোর ছবি ব্যাকড্রপে আঁকা যেতে পারে। এতে তারা আকৃষ্ট হবে।

 

অভিভাবকদের জন্য

- একেবারে ছোটবেলাতেই বইয়ের সাথে সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তিন থেকে ছয় মাস বয়সেই শিশুদের কাছে বই দেয়া উচিত। সেই বইগুলো এমন হতে পারে, যাতে কোনো লেখা নেই, শুধু ছবি আছে।

- যখন শিশু একটু একটু কথা বলতে শেখে ও বুঝতে শেখে তখন তাকে বই পড়ে শোনাতে হবে। যখন শিশু পড়তে শিখে যায় তখন তার হাতে বই দিয়ে দিতে হবে।

- বই কেনার জন্য পারিবারিক বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। সন্তানদের পছন্দমতো বই কেনার স্বাধীনতা দিতে হবে।

- অল্প বয়স থেকেই শিশুদের বই কিনে দিতে হবে এবং লাইব্রেরিতে, বইমেলায় এবং বইয়ের দোকানে নিয়ে যেতে হবে। 

- বিভিন্ন উৎসব ও জন্মদিনে উপহার হিসেবে বই দিলে শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।

- শিশুরা বই পড়ে এসে যদি গল্পটা মা-বাবা বা পরিবারের বড়দের শোনাতে চায় তাহলে তা আগ্রহ নিয়ে শুনতে হবে।

- মা-বাবারা আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বই এনে সন্তানদের দিতে পারেন। শিশুদের বন্ধুদের সাথে বই বিনিময়ে উৎসাহিত করতে হবে।

- মা-বাবার নিজেদেরও বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। মা-বাবাকে বই পড়তে দেখলে শিশুরা জানবে যে বই পড়া প্রতিদিনের জীবনের একটা অংশ।

- ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পরিমিত ব্যবহার ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে। মা-বাবার দায়িত্বই তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া।

- বই পড়ায় উৎসাহিত করার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকতে শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে। তাদের সামগ্রিক বিকাশের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত খেলাধুলা এবং অবসর কাটানোর সুযোগ করে দিতে হবে।

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/শিক্ষকদের জন্য

- শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে পাঠাগার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট সময় তারা যেন পাঠাগারে কাটায় সে নিয়ম তৈরি করতে হবে। এছাড়া, প্রতি সপ্তাহে পাঠাগার থেকে বই নিয়ে বাসায় বসে পড়ার নিয়ম তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

- শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে বিদ্যালয়গুলির অধিকতর সক্রিয় হতে হবে। লাইব্রেরি কার্যক্রম, বই পড়া প্রতিযোগিতা, কোনো বই পড়ার পর তার জন্য নতুন প্রচ্ছদ ডিজাইন করার প্রতিযোগিতা এবং তারপর সেসব প্রচ্ছদ নিয়ে প্রদর্শনী ইত্যাদিও আয়োজন করা যেতে পারে।

- শিশুরা বছরের নির্দিষ্ট দিনে তাদের প্রিয় গল্পের চরিত্রের মতো সেজে বিদ্যালয়ে আসতে পারে।


শনি, ২১ জানু ২০২৩, সকাল ৯:২৩ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ