শিশুদের অর্থপূর্ণ জীবন গড়ায় জোর দেই, ভাল ফলাফলে শুধু নয়

শিশুদের অর্থপূর্ণ জীবন গড়ায় জোর দেই, ভাল ফলাফলে শুধু নয়

ইমতিয়াজ সেলিম

কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তির সময় খেয়াল করলাম ডিপার্টমেন্টে আমি সবার প্রথমে ভর্তি হয়েছি। বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে আমার ভর্তি প্রক্রিয়া একটু আলাদা ছিলো। একটু না, বেশ ভালই আলাদা ছিলো। কেননা, ডিপার্টমেন্টের ভর্তির দিন-তারিখ, মানে সার্কুলার অনুযায়ী ভর্তি হওয়ার তারিখ টা কয়েকদিন পরে ছিল। যেহেতু আমাকে দেশ থেকেই যাবতীয় ভর্তি ও ভিসা সংক্রান্ত প্রক্রিয়া মিটিয়ে আসতে হয়েছে, তাই আমার ভর্তিটাও আগে ভাগেই হয়ে গেলো। সেই সাথে বোনাস হিসেবে পেয়ে গেলাম সেই বহুল প্রতীক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত যাই বলেন, রোল নম্বর ১।

বিষয়টা প্রথমে খেয়াল করিনি। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রোল নম্বর সাধারণত এক বা দুই সংখ্যার হয়না; বেশ কয়েক সংখ্যার এক বিশাল আইডি নম্বর হয়। যাই হোক, বিষয়টি খেয়াল করলাম ক্লাস শুরু হবার পর। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আইডি নম্বরের শেষ দুই সংখ্যাকে রোল নম্বর হিসেবে ধরে স্যার-ম্যাডামরা রোল কল করছিলেন। প্রথম কয়েকদিন সকল স্যার, ম্যাডামই নাম এবং রোল একসাথেই ডাকছিলেন যাতে সবাই নিজেদের রোল সম্পর্কে একটু পরিচিত হতে পারে। কিন্তু যেদিন প্রথম রোল কল করা হলো শুধুমাত্র রোল নম্বর দিয়েই, সেদিন স্যার রোল ১ দুই-তিনবার ডাকার পরও কোন সাড়া না পাওয়ায় আমার পাশে বসা বন্ধুটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আমার রোল নম্বর ১। আর সাথে সাথেই আমি সাড়া দেই এবং তা দেখে স্যারও আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন। আমি নিতান্তই নিষ্পাপ পাপীর মত স্যারকে বললাম, “দুঃখিত স্যার, জীবনে রোল নম্বর কখনো ১ হয়নি তো তাই প্রস্তুত ছিলাম না।“ আর সেটা শুনেই পুরো ক্লাস যেন সেবছরের সেরা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের খেতাবটা আমার নামে লিখে দিলো। মোটেই বাড়িয়ে বলছিনা। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি নিয়ে লিখবো বলে শুরু করেছিলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা দিয়ে শুরু করে ফ্ল্যাশব্যাকে যাবো ভেবে যে এতো কিছু লিখে ফেলবো সেটা বুঝতে পারিনি। যাই হোক, ঢাকা শহরে প্রাথমিক আর মাধ্যমিক আলাদা বিদ্যালয়ের চল অনেক আগে থেকেই কম। প্রায় সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। আর রাজধানীর একটি স্বনামধন্য স্কুল হওয়ার কারণে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে একটা ট্রেন্ড ছিলো “রোল নম্বর দশের মধ্যে কিংবা বিশের মধ্যে না থাকলে ভালো ছাত্র হিসেবে কেউ ভাবে না।“ 

যে সময়টার কথা বলতে চাইছি সেটা ২০০২ সাল। আমি নিজেকে একজন দুর্বল ছাত্র হিসেবেই মূল্যায়ন করবো। কেননা আমার রোল দশ তো দূরে থাক, বিশের মধ্যে এসেছিলো মাত্র একবার। তাও আবার তৃতীয় শ্রেণীতে। সে বার নিজের রোল ১৬ হওয়ার কারণে স্বভাবতই নিজেকে “ভালো ছাত্রদের” কাতারে ফেলে এমন গর্ব বোধ করছিলাম যেন জীবনে এর চেয়ে বড় গর্বের বিষয় আর কিছু হতেই পারেনা। পরীক্ষার হলেও আসন থাকতো ভালো ছাত্রদের মাঝে। এই রোল নম্বর শুরুর দিকে থাকাতে যে খুব লাভ হয়েছে, কিংবা ভালো ছাত্রদের মাঝে বসে পরীক্ষাগুলোতেও যে অনেক ভালো করেছি তা নয়। বরং ভালো রোল নম্বর থাকার জৌলুসে আমার পড়াশোনাটা একদম লাটে উঠে গিয়েছিলো। আমি আসলেই প্রস্তুত ছিলাম না স্কুলে আমার রোল নম্বরটা ধরে রাখার, কিংবা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

বাসায় তখন আর দশটা সাধারণ পরিবারের মত আমার পরিবারেও বিষয়টি মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো যে করেই হোক রোল নম্বরটা যেন ভালো অবস্থানে থাকে। আমার মা কিংবা বাবা কখনোই রোল ১ থেকে ১০ এর মধ্যে থাকতে বলেন নি। তবে তারা এও মনে করতেন যে অন্তত বিশের পরে রোল চলে গেলে আর ভালো ছাত্র হওয়া সম্ভব নয়। সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়বে। আর ম্যাট্রিক, ইন্টারের রেজাল্ট তো খারাপ হবেই।

সে যাই হোক। ওইটুকু বয়সে একটা শিশুর যে মানসিক বিকাশ ঘটে তা অপরিহার্য একটি ব্যাপার। আর সেই বিকাশের চাইতে যদি ভালো রেজাল্ট করে ভালো রোল নম্বর পাওয়াটাই একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে নানা সমস্যা হতে পারে। শুধু ভাল ছাত্র হতে গিয়ে হয়তো অনেকেই জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার দক্ষতা অর্জন করে না। তবে রোল নম্বর নিয়ে টেনশন না করা অনেক ব্যাকবেঞ্চার বন্ধুদের আমি দেখেছি যারা তখন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আগ্রহ নিয়ে অনেক ভাবতো, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতো। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই ছিল খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ। তাদের মধ্যে আমি দেখেছি যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা। ভালো ছাত্রদের মাঝেও দেখিনি তা নয়। আর তাছাড়া, স্কুলে প্রত্যেক বছর সবার পেছনে থাকা ছেলেটাকেও এখন দেখছি বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে স্কলারশিপে পড়তে।

স্কুলে আমরা যদি কেবল গৎবাঁধা জ্ঞান লাভ আর ভালো রোল নম্বর অর্জনের মাধ্যমেই জীবনে এগিয়ে থাকার একমাত্র উপায় ভাবতাম, তাহলে কি পেছন দিকে থাকা ছাত্ররা আজ মধ্যবয়সে এসে সত্যিই পিছিয়ে রয়েছে? কই? অন্তত আমার বন্ধুদের ক্ষেত্রে আমি তো সেটা দেখতে পাই নি আজ অবধি?

সন্তানকে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে ভালো রোল নম্বর নয়, বরং জ্ঞান ও পরিপূর্ণ শিক্ষালাভে উদবুদ্ধ করুন। তাদের আগ্রহের বিষয়গুলিতে উৎসাহ দিন। কোন টার্গেট পূরণ নয়, শিশুরা যেন আনন্দের সঙ্গে বেড়ে ওঠে তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলেই তারা জীবনে অর্থপূর্ণ কিছু করতে পারবে।

ছবিঃ © ইমতিয়াজ সেলিম/শিশুরাই সব


বৃহস্পতি, ৩১ ডিসে ২০২০, দুপুর ৩:৪৫ সময়

মতামত/ পরামর্শ/ প্রশ্ন


“শিশুরাই সব” এর এ পর্যায়ে আমরা আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করছি।
ওয়েবসাইটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কি ধরণের বিষয় দেখতে চান তা জানান। লেখা পড়ে, ভিডিও দেখে শেয়ার বা মন্তব্য করুন। সন্তান পালন বা শিশুসংক্রান্ত বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে জানান। আমরা উত্তর দেব।
ওয়েবসাইটে শিশুদের জন্য আপনার ভাবনাগুলো লিখে পাঠান (সর্বোচ্চ ৫০০ শব্দ)। এছাড়া নিজের বা আপনার সংস্থার ভিডিও, রিপোর্ট, অনুষ্ঠানের তথ্য ইত্যাদি শেয়ার করুন। উপযুক্ত হলে আমরা প্রকাশ করব।

যোগাযোগ